রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালক হিসেবে উভয়সংকটে আমলারা
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান ও পর্ষদ সদস্য নিযুক্ত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব থেকে সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কোনো কোনো কর্মকর্তা রয়েছেন একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে। আইন মেনে এসব নিয়োগ দেয়া হলেও বিষয়টি প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিতে জটিলতা সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব নিয়োগ স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করছে বলেও মত প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, পাওনা অর্থ পরিশোধ নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও টেলিটকের মধ্যে। আর এ বিরোধ মীমাংসায় উভয়সংকটে পড়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। একই কারণে তিনি প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে সরকারের বিপুল অংকের অর্থ পাওনা থাকলেও তা আদায়ে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
আইজিডব্লিউ লাইসেন্সের অধীনে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান ও আইসিএক্স লাইসেন্সের আওতায় আন্তঃসংযোগ সেবা দিচ্ছে বিটিসিএল। কল আদান-প্রদানে আয় ভাগাভাগির অংশ হিসেবে প্রাপ্য অর্থ নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এছাড়া সেবা প্রদানে বিটিসিএলের বিভিন্ন অবকাঠামো ভাড়ার ভিত্তিতে ব্যবহার করছে টেলিটক। এ বিষয়টি নিয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে বিটিসিএলের কাছে সরকারের পাওনা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটকের কাছে সরকারের পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। থ্রিজি লাইসেন্সের আওতায় বরাদ্দ দেয়া তরঙ্গের ফি বাবদ বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, লাইসেন্সধারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বকেয়া অর্থ আদায়ে বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিসিএল ও টেলিটকের বিষয়ে নমনীয় অবস্থান দেখিয়ে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সরকারের পাওনা বিপুল অর্থ পরিশোধের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় তা খাতের শৃঙ্খলা ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুষম ক্ষেত্র বজায় রাখতে বিরূপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অর্থ আদায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগেও একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, বিটিসিএল, টেলিটক বা সাবমেরিন কেবল কোম্পানির মধ্যে কোনো মতবিরোধ হলে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে নির্দেশনা বা সুপারিশ পাঠানো বেশ জটিল হয়ে পড়ে। মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে সব প্রতিষ্ঠানেরই বোর্ড চেয়ারম্যান পদে একই ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করেন। ফলে কোনো মতবিরোধ হলে মন্ত্রণালয়ের সচিব কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটি বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, পদাধিকারবলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, টেলিটক, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল), টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) ও বাংলাদেশ কেবল শিল্প লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে একাধিক পদে দায়িত্ব পালন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে না বলে মনে করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার। তিনি বলেন, আইন যেভাবে হয়েছে, যুগ যুগ ধরে সেভাবেই চলে আসছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব থাকা ইতিবাচক। তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকে, যার ফলে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনেও সুবিধা হয়। স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিধিবিধান অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আইন বা নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই।
একইভাবে অধীনস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে— ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। পরিচালক হিসেবেও তিনি রয়েছেন একাধিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে।
রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত সরকারি সংস্থা এনবিআর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। পাশাপাশি তিনি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস, হোটেল রূপসী বাংলা ও সোনারগাঁওয়ের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রাজস্ব নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে বিবাদ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির সঙ্গে রাজস্ব নিয়ে এনবিআরের মতপার্থক্য ও দরকষাকষি রয়েছে। এনবিআরের বেশ কয়েকজন সদস্য এসব কোম্পানির পর্ষদে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সচিবরা মূলত প্রশাসক ও প্রমোটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মিত এ দায়িত্বের বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পান তাদের অনেকে। তবে একাধিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর অর্পিত নিয়মিত দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতাসক্ষম করে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পরস্পরবিরোধী স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুটি ক্ষেত্রে দায়িত্বরত আরেক কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব আকবর হোসেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পদাধিকারবলে তিনি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। প্রকল্প ও ব্যাংক উভয়ের শীর্ষ পদে একই ব্যক্তি দায়িত্বে থাকায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংক পরিচালনার জন্য দক্ষ ব্যাংকার প্রয়োজন। সচিবরা নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রাজ্ঞ হলেও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত নন। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে তিনি প্রকল্পের সফল্য চাইবেন, এটিই স্বাভাবিক। প্রকল্প দীর্ঘায়িত হলে সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিবদেরই লাভ। অন্যদিকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক সফল হলে প্রকল্প থাকবে না। এ কারণে ব্যাংকটি সফলতার মুখ দেখবে কিনা, এটিই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।
তবে অতীতে থাকলেও এখন একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প পরিচালক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি পদের মধ্যে স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি করেন অতিরিক্ত সচিব আকবর হোসেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালের জুনের মধ্যে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তখন শুধু পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকই কার্যক্রম চালাবে। প্রকল্পের জনবল দিয়েই এখন ব্যাংকের কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংক পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
Leave a Reply