রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লুণ্ঠন ও রাষ্ট্রীয় অর্থ জোগানের সহগমন

জেসমিন মলি | ০১:৫২:০০ মিনিট, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৭

base_1496601505-7

সংকটের দ্রুততা, ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। চিকিত্সাশাস্ত্রের ভাষায় যাকে ‘মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউর’ বলা যেতে পারে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জীবন বাঁচাতে সরকারি কোষাগার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা জোগান দেয়া হয়েছে। তবে সংকট এখনো থামেনি। ব্যাংকিং খাতের পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এখনো অনেক কিছুই লুকিয়ে বা ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো বের হলে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়, গোটা ব্যাংকিং খাতই বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদনের তথ্যে এসব চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদন তৈরিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভিন্ন সুপারিশ আমলে নেয়া হয়েছে।

খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে রাখতে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার এর দ্বিগুণেরও বেশি, ২৭ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ৭৪ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণই ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ চার বছরেই এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বড় অংশই রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে। এসব গ্রাহকের কাছে আটকে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ১১ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ২১৮ কোটি, রূপালীর ২ হাজার ২৩২ কোটি, বেসিকের ২ হাজার ১০০ কোটি, অগ্রণীর ১ হাজার ১৬৯ কোটি ও বিডিবিএলের ৩৭৬ কোটি টাকা শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে।

ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়ায় খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। নিয়ম-কানুন না মেনে এসব ঋণ দেয়ায় তা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে। মূলধন হিসেবে প্রতি বছরই সরকারকে বড় অংকের অর্থ জোগান দিতে হচ্ছে।

২০১৩-১৪ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের কোষাগার থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোয় জোগান দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। গত চার অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে বেসিক ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা নতুন করে জোগান দেয়া হয়েছে। এর পরের অবস্থানে থাকা সোনালী ব্যাংকে গত চার অর্থবছরে দেয়া হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে ১ হাজার ৮১ কোটি, জনতায় ৮১৪ কোটি ও রূপালীতে ৩১০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে (বিকেবি) ৭২৯ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) ৩১০ কোটি টাকা সুদ ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক বছর আগে সংঘটিত অনিয়মের জের এখনো টানতে হচ্ছে সোনালী ব্যাংককে। আমরা সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করছি। বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক খেলাপি ও বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির কারণে সোনালী ব্যাংকের পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। ২০১৭ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করায় সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৯১ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা পর্যায়ক্রমিকভাবে তৈরি হয়েছে বলে জানান অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে সময় দিতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলো একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরের অবস্থা খানিকটা ভালো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থা বেশ ভালো।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে দুদক। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদনে দুদকের এসব সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো— কুঋণের সার্বিক বিষয় বিশেষ নিরীক্ষার আওতায় আনা, পুনঃতফসিলীকরণের আগে ঋণটি জামানত দ্বারা আবৃত কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া ও ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে পুনঃতফসিলের জন্য বিবেচনা না করে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া। এছাড়া ঝুঁকি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করতে সমীক্ষা পরিচালনা এবং সে অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি ধরা পড়লে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও পরিচালনা পর্ষদ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে দুদক।

পরিস্থিতির উন্নয়নে সুশাসন নিশ্চিতের বিকল্প নেই বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় খেলাপি ঋণ লাগামহীন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এজন্য বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সংস্কার করতে হবে।

Leave a Reply