ব্যাটারিবিহীন সোলার সিস্টেম উদ্ভাবন সৌরবিদ্যুতে খরচ কমবে ৭৫%
| নভেম্বর ০৪, ২০১৬
সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর বসছে প্রায় ৩০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম। প্রচলিত ধারার এসব সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টে ব্যাটারি ব্যবহার করায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়ছে অত্যধিক, প্রতি ইউনিট ৩০-৩৫ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টিও। তবে ব্যাটারিবিহীন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিরল সাফল্য দেখিয়েছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) একদল বিজ্ঞানী। এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমবে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
দেশে বৃহৎ পরিসরে এ পদ্ধতিতে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমস্যা নিরূপণে ৬৪ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারিবিহীন একটি সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট বিসিএসআইআরের অভ্যন্তরীণ গ্রিডের সঙ্গে স্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা যায়, স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট (ব্যাটারিবিহীন) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি মাত্র ৭ টাকা ৩৭ পয়সা, প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে যা অনেক কম। শুধু তা-ই নয়, অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে এ খরচ আরো কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। ২৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১২ সালে, চলতি বছরের জুনে যা শেষ হয়।
বিসিএসআইআরের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক শাহরিয়ার বাশার বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১২ সালে যখন প্রকল্পটি নেয়া হয়, তখন সারা বিশ্বেই ব্যাটারিবিহীন সোলার প্যানেল ধারণাটি ছিল নতুন। তবে প্রকল্পটি থেকে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। বিসিএসআইআরের প্রধান কার্যালয় ও জয়দেবপুর কার্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যাটারিবিহীন সোলার সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। কার্যকর হওয়ায় বেশকিছু বেসরকারি উদ্যোক্তা এরই মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাটারিবিহীন সোলার প্যানেল স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছেন। সাধারণ ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে আমরা সোলার প্যানেলে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ কমিয়ে আনতে আরো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি।
দেশে প্রচলিত সব সৌরবিদ্যুৎ প্লান্টেই ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। এতে রাতের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয়। কিন্তু সৌরবিদ্যুতে ব্যবহূত সাধারণ মানের একটি ব্যাটারির জীবত্কাল মাত্র দুই বছর। আর সোলার প্যানেলের জীবত্কাল ২৫ বছর। ফলে একটি সোলার সিস্টেমের জীবত্কালে ১০-১২ বার ব্যাটারি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। ফলে এ ধরনের সোলার সিস্টেমের জীবত্কালে উৎপাদিত বিদ্যুৎ খরচ দাঁড়ায় ইউনিটপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা।
ব্যয়বহুল ব্যাটারির বিকল্প থিন ফিল্ম সোলার সেল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন বিসিএসআইআরের গবেষকরা, যার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। এ থিন ফিল্ম সেলের আয়ুষ্কাল প্যানেলের সমান হবে। পাশাপাশি এর খরচও কম। তাই দেশের সব সোলার হোম সিস্টেম এ পদ্ধতিতে উন্নীত করা গেলে সৌরবিদ্যুৎ আরো সহজলভ্য হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, এখন পর্যন্ত সারা দেশে সোলার হোম সিস্টেম রয়েছে ৪৫ লাখ। সোলার সেচ পাম্প রয়েছে ২১৩টি। এখন পর্যন্ত স্থাপিত সোলার প্লান্টের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৭৫ মেগাওয়াট। ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বিসিএসআইআরের গবেষকরা বলছেন, স্বল্পখরচে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের এ পদ্ধতি বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌরনির্ভর বিদ্যুেকন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা বাড়াবে। তাছাড়া পদ্ধতিটি ব্যবহার করে সৌর সেচ ব্যবস্থা প্রচলন করা গেলে সেচকাজে প্রয়োজনীয় ১০ লাখ টন ডিজেল সাশ্রয় হবে।
জ্বালানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশগত সুরক্ষারও একটি মূল্যায়ন করেছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিসিএসআইআরের অভ্যন্তরীণ গ্রিডের সঙ্গে স্থাপিত ৬৪ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারিবিহীন সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম থেকে বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে তা উৎপাদন করলে ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হতো প্রায় ১ হাজার ৩১৮ টন। আর এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রয়োজন পড়ত ৩ হাজার ৬৫ ব্যারেল।
স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রকল্পটির আরো কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আমদানিকৃত সোলার প্যানেলের গুণগত মান নিরূপণ, জনশক্তি উন্নয়নে জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জনবলের সোলার প্যানেল প্রস্তুতকরণের গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি।
দেশে সোলার হোম সিস্টেমে ব্যবহূত সোলার প্যানেল, চার্জ কন্ট্রোলার ও ব্যাটারি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানি করা এসব সোলার প্যানেল ও সেলের মান নিরূপণ করার কোনো ব্যবস্থা এর আগে ছিল না। প্যানেলের রেটিং সম্পর্কে প্যানেল প্রস্তুতকারক বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হতো। এতে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যেত। জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সংগৃহীত যন্ত্রপাতি দিয়ে আমদানিকৃত সোলার প্যানেলসহ চার্জ কন্ট্রোলার ও ব্যাটারির গুণগত মান পরীক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
Leave a Reply