বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে আইএমইডির প্রতিবেদন মজুদ নিরূপণ না করেই প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা
জেসমিন মলি | ২০১৬-০১-১১ ইং
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র পুনরুন্নয়ন প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্যাসের মজুদ নিরূপণ করা। বিভিন্ন গ্যাস স্যান্ডের বিস্তৃতি নিরূপণও ছিল প্রকল্পের আরেকটি উদ্দেশ্য। এসবের কোনোটি না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে প্রকল্পটি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র পুনরুন্নয়ন (প্রথম পর্যায়) (সংশোধিত) প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০০৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১২৭ কোটি টাকা। গত বছরের ৩ ও ৪ জানুয়ারি গ্যাসক্ষেত্রটি পরিদর্শন করেন আইএমইডির কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি সরকারি প্রতিশ্রুতি-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরিদর্শন প্রতিবেদনটি জমা দেয় আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস মজুদের প্রকৃত অবস্থা ও বিভিন্ন গ্যাস স্যান্ডের বিস্তৃতি নিরূপণ না করায় প্রকল্পের উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন ও গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এসব কাজ যাতে করা হয়, সে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সরকারি প্রতিশ্রুতি-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী কেরামত আলী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আইএমইডির পরিদর্শন প্রতিবেদনের ওপর পর্যালোচনা হয়েছে। আইএমইডি যেসব সুপারিশ করে, তা পরিপালনের জন্য কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনকারী সংস্থা হিসেবে বাপেক্সের এ কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বাপেক্সের কার্যক্রম শুধু ড্রিলিং সার্ভিসেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কাজটি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত না করাকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার গাফিলতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইএমইডি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের বেশকিছু অংশে অননুমোদিতভাবে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (আরডিপিপি) অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আবার প্রকল্পের বহির্নিরীক্ষা বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের করার কথা থাকলেও তা করেছে প্রকল্প সম্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দেয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় বাখরাবাদ গ্যাসফিল্ডে বন্ধ হয়ে যাওয়া দুটি গ্যাসকূপের মধ্যে একটির ওয়ার্কওভার (কূপ নং-২) সম্পাদন ও নতুন একটি কূপ খননের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এতে দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণে কিছুটা হলেও অবদান রেখেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি কূপের গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ আরডিপিপিতে লক্ষ্যমাত্রার (প্রতিদিন ১৫-১৮ মিলিয়ন ঘনফুট) চেয়ে কম হলেও পরবর্তীতে তা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পায়। ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৪-এর মে পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন আরডিপিপির লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। এর পর থেকে উৎপাদন ক্রমে কমতে থাকে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দুটি কূপের গড় উৎপাদন ছিল ১৪ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া কূপ দুটি উৎপাদনে আসার পর প্রথম বছরে গ্যাসের উপজাত হিসেবে ৩ হাজার ৫৫৯ ব্যারেল কনডেনসেট থেকে ডিজেল ও পেট্রল উৎপাদন করা হয়।
আইএমইডির পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাখরাবাদ ৫ নং কূপের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত ‘বি’ গ্যাস স্যান্ড জোনের উপরিভাগ থেকে গ্যাস পাওয়া যায়নি। আরো গভীরে অন্যান্য স্যান্ড জোনে গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ থাকলেও ওয়ার্কওভার রিগের কার্যক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে তা করা যায়নি। ফলে এ প্রকল্পের আওতায় বাখরাবাদ ২ নং কূপ গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র পরিদর্শন শেষে বেশকিছু সুপারিশও করেছে আইএমইডি। বিদ্যমান কূপে ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম গ্রহণের আগে সমীক্ষা কার্যক্রমে অর্থনৈতিক ও কারিগরি বিশ্লেষণ সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি অধিকতর গভীরতায় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন রিগসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহের বিষয়ে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে বলে সুপারিশ করেছে আইএমইডি। এছাড়া আরডিপিপির অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি যাতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নিরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়, সে সুপারিশও করা হয়েছে।
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র ১৯৬৯ সালে শেল অয়েল আবিষ্কার করে। তখন একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। ক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৮৪ সালের মে মাসে। ১৯৮১-৮২ সালে চারটি ও ১৯৮৯-৯০ সালে আরো তিনটি নতুন কূপ খনন করা হয়। সব মিলিয়ে এ ক্ষেত্রে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ ধরা হয় প্রায় ৩২০ বিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার জরিপ অনুযায়ী, দেশে আবিষ্কৃত গ্যাস মজুদের পরিমাণ ২০ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ব্যবহার হয়েছে ১২ দশমিক ৪১ টিসিএফ। বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৮ দশমিক ২৩ টিসিএফ গ্যাস। দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ টিসিএফ করে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। এ হিসাবে বাংলাদেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ দিয়ে সর্বোচ্চ আট বছর চালানো যাবে।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্যাস মজুদ রয়েছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে। তাদের আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ প্রায় ৪ টিসিএফ। আর তিতাসের গ্যাস মজুদের পরিমাণ আড়াই টিসিএফ।
দেশের ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ হিসাব পর্যালোচনা করে এ তথ্য উপস্থাপন করে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির প্রতিবেদনে আগামী পাঁচ বছরের গ্যাসের চাহিদা পর্যবেক্ষণ করে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে শুধু বিদ্যুেকন্দ্রেই দৈনিক ২ হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে। চলতি বছর বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে দৈনিক ১ হাজার ৮৫২ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৯৫৪ মিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে বিদ্যুতে গ্যাস লাগবে ২ হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট। একই সঙ্গে সার উৎপাদনে ২০১৯ সালে দৈনিক গ্যাস লাগবে ৩১৭ মিলিয়ন ঘনফুট।
Leave a Reply