জিডিপিতে অবদান লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে দেশের শিল্প খাত

জেসমিন মলি ও মাসুম বিল্লাহ | ২০১৬-০১-০৭ ইং

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্যতম লক্ষ্য ছিল সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প খাতের অবদান বাড়ানো। এ আশা নিয়ে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ধরা হয় ৩৮ শতাংশ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এ লক্ষ্য থেকে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে দেশের শিল্প খাত।

পঞ্চবার্ষিক এ পরিকল্পনার শেষ বছর অর্থাত্ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের জন্য জমি ও গ্যাস-বিদ্যুত্ সংকটের কারণে এ খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হয়নি। এতে লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ে খাতটি।

শিল্পে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় খাতটি জিডিপিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারেনি বলে মনে করেন শিল্পোদ্যোক্তারা। আর বিভিন্ন জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে বাড়েনি বিনিয়োগ।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও এনার্জিপ্যাকের সিইও হুমায়ুন রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত দুটি কারণে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ জমির অপর্যাপ্ততা, অন্যটি বিদ্যুতের অপ্রতুলতা। এর বাইরে যেসব কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না তার মধ্যে অন্যতম হলো, সুশাসন পূর্ণমাত্রায় কার্যকর না হওয়া। জমি পাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা সংযোগ পাওয়া ও চূড়ান্তভাবে কারখানা চালু করা পর্যন্ত এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাজ করে। এগুলো কমাতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়বে না।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর একটি প্রতিবেদন পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। এতে দেখা গেছে, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর ২০১০-১১ অর্থবছরে শিল্প খাতে ৯ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও এর বিপরীতে প্রকৃত অর্জন ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশের বিপরীতে অর্জন হয় ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছর ৯ দশমিক ৯-এর বিপরীতে ৯ দশমিক ৬৪, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৭-এর বিপরীতে ৮ দশমিক ১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্য অনুপাতে অর্জন হয়নি। এ খাতের প্রবৃদ্ধি প্রথম দিকে ভালো হলেও শেষ দুই অর্থবছরে হোঁচট খেয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন হয় ১০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর পরের দুই অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। কিন্তু ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লক্ষ্য অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হয়নি এ খাতে। অর্থবছর দুটিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৭৭ ও ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ। যদিও লক্ষ্য ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৭ ও ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।

এদিকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিল্প খাতের লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নতুন করে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালে। সে পর্যন্ত শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২০ সাল নাগাদ সার্বিক অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান প্রাক্কলন করা হয়েছে জিডিপির ৩৩ শতাংশ। এছাড়া সেবা খাতে ৫৪ দশমিক ১ ও কৃষিতে ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্জনের অভিজ্ঞতার আলোকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জনযোগ্য।

জানা যায়, বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন মুখ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। শিল্পে এ হার মাত্র ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষিতে এখন কর্মসংস্থান বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমেই কেবল অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ লক্ষ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আওতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানান উদ্যোক্তারা।

একসময় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল কৃষি খাতের। কিন্তু শিল্পোন্নয়নের ধারা জোরদার হলে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। শিল্পে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হওয়ায় তা কৃষির অবদানকে ছাড়িয়ে যায়। শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেবা খাতের ওপরও চাপ কমতে থাকে। শিল্পে উচ্চপ্রবৃদ্ধির মাধ্যমে জিডিপিতে এ খাতের অবদান বাড়ানোর লক্ষ্য নেয়া হলেও এখনো এককভাবে সেবা খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। কৃষির ওপর থেকে নির্ভরশীলতাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমেনি। জিডিপিতে এ দুই খাতের অবদান এখনো লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে কৃষি ও সেবা খাতের অবদান ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও ৪৭ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে জিডিপিতে এ দুই খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৬ ও ৫৩ দশমিক ৬২ শতাংশ।

এদিকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মাথাপিছু আয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে তার চেয়ে বেশি অর্জিত হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নেয়া হলেও এর বিপরীতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে অর্জিত হয়েছে ১ হাজার ৩১৪ ডলার। এ সময়ে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৩৫ ডলার।

অন্যদিকে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ষষ্ঠ  পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৫ সাল নাগাদ দেশের মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু এর বিপরীতে অর্জন হয় ২৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। মূলত লক্ষ্য অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ উজ্জীবিত করা যায়নি। ফলে বিনিয়োগের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি বলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

 

Leave a Reply