অর্থ পাচার অনুসন্ধানে অনাগ্রহী দুদক

জেসমিন মলি | ২০১৫-০৭-১২ ইং

www.bonikbarta.comবাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার ক্রমেই বাড়ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, ২০১১ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। যদিও তা অনুসন্ধানে খুব বেশি আগ্রহী নয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থ পাচারের কিছু অভিযোগ তারা অনসুন্ধান করলেও তা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট।

দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪তে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে কমিশন অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্ব দিয়েছে। সে বছর কমিশন ২২৬টি অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০১২ সালের তুলনায় ছয় গুণ। দুদক ২০১২ সালে ১১০টি এবং ২০১৩ সালে ১৮২টি অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। ২০১১ সালে সংস্থাটি এ ধরনের ৭৯টি অভিযোগে অনুসন্ধান চালিয়েছিল।

তবে অর্থ পাচার রোধে কমিশনের সক্রিয়তা বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামানের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এসবের মধ্য দিয়েও আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থ ফেরতও এসেছে। ভবিষ্যতে পাচারকৃত আরো অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।

দুদকের হিসাবে গত বছর অর্থ পাচারের অভিযোগের সংখ্যা পূর্ববর্তী ২০১৩ সালের তুলনায় দেড় গুণ। গত চার বছরে অর্থ পাচার-সংক্রান্ত ৫৯৭টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে দুদক। এসব অভিযোগের মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১৬০টি অভিযোগের। অর্থাৎ ৪৩৭টি অনুসন্ধানেরই ফলাফল পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়ছে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে একটি বড় অংশের অর্থ পাচারের ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায় না।

অভিযোগ রয়েছে, আমদানির নামে দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচার হচ্ছে। একইভাবে বিদেশ থেকে তুলা আমদানির নামে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অতিরিক্ত মূল্যে তুলা আমদানি করে একদল ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করছেন বলে অভিযোগ করেন বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। আবার একদল ব্যবসায়ী আছেন, যাদের উৎপাদনশীল কোনো খাতে বিনিয়োগ নেই; কিন্তু ট্রেডিং বা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডেই তারা বেশি জড়িত। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের পুঁজি কাজে লাগান। অভিযোগ রয়েছে, এরাই মূলত অর্থ পাচারে জড়িত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান অন্য যেকোনো অভিযোগ তদন্ত ও অনুসন্ধানের তুলনায় জটিল। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের যথাযথ সামর্থ্য বা দক্ষতা রয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থ পাচারের অভিযোগের ব্যাপকতা এত বেশি যে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে নেয়া একা দুদকের পক্ষে কতখানি সম্ভব, সেটিও ভাবনার বিষয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সঙ্গে দুদকের যোগাযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। অর্থ পাচার এবং অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই।

আইন অনুযায়ী, মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে দুদককে। অর্থ পাচারের অভিযোগের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণের জন্য দুদক বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের ওপর নির্ভরশীল। তবে সংস্থা তিনটির সমন্বয়হীনতার কারণে অর্থ পাচারের অনেক অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় নয়। অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তে দুদকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পৃথক উইং খোলার সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছে কমিটি।

প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৪ সালে কমিশন অর্থ পাচারের ৮৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। এসব অভিযোগের মধ্যে ২০টিতে মামলা করা হয়। আগের বছরের ১৩৭টি অনুসন্ধান অনিষ্পন্ন ছিল। গত বছর দুদক নিষ্পন্ন করেছে ৬০টি অনুসন্ধান। আগের বছরের অনিষ্পন্ন অনুসন্ধানসহ বছর শেষে কমিশনের মোট অনুসন্ধানের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৬। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ৪০টি অভিযোগ নথিভুক্তির সুপারিশ করা হয়।

২০১৩ সালে কমিশন অর্থ পাচারের ৪৭টি মামলা তদন্ত করে ৩৯টিতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। সে বছর মোট অভিযোগের ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ তদন্ত করতে সমর্থ হয় সংস্থাটি। ২০১২ সালে কমিশন ৬৮টি নতুন এবং ৩৪টি অনিষ্পন্ন অনুসন্ধানের কাজ করে। এর মধ্যে ২৯টি তদন্তের কাজ সম্পন্ন হয়, যার মধ্যে ২৫টিতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১২ সালে কমিশন প্রাপ্ত অভিযোগের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশের তদন্ত শেষ করতে সমর্থ হয়। একইভাবে ২০১১ সালে কমিশন নয়টি অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করে এবং আদালতে আটটি অভিযোগপত্র দাখিল করে। সে বছর ২২ শতাংশ অভিযোগের তদন্ত শেষ করতে সমর্থ হয় কমিশন।

দশম জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সপ্তম বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ পাচার বা সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়নের অভিযোগ কিংবা সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে, তা প্রমাণ এবং আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, সিআইডি ও দুদক সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। এতে এনবিআরের ভূমিকা আরো কার্যকর করতে মানি লন্ডারিং আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দুদকের সংশ্লিষ্টতা ও ভূমিকা বৃদ্ধির জন্য এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানি লন্ডারিং তদন্তের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে দুদকের যোগাযোগ এবং আন্তঃসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন।

অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে দুদকের সহায়তা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য চিঠি পাঠানো হলেও আইনি জটিলতায় সেসব তথ্য দুদক সংগ্রহ করতে পারে না।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা দুদককে তথ্য দেবে কিনা, এ সমস্যার সমাধান হয়নি।

সূত্র আরো জানায়, দুদকের সঙ্গে এসব সংস্থার বিভিন্ন বৈঠকে সহায়তা বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থ পাচারের নতুন নতুন কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়। এসব অর্থ পাচার রোধে মোবাইল ব্যাংকিংকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলা হয়। অবৈধ ব্যাংকিং, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা, কুরিয়ারের মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা অর্থ পাচার করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। এছাড়া দেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশী নাগরিকদের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে দুদক ও ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যৌথভাবে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। তবে এসব কর্মপরিকল্পনা কার্যকরে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক খাতকে গতিশীল করতে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০৯-এ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে ঘুষ ও দুর্নীতিকে সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

 

Leave a Reply