রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে বিকল্প পন্থা খুঁজছে ব্যাংকিং বিভাগ
মীর মনিরুজ্জামান ও জেসমিন মলি | ২০১৫-১০-০৮ ইং
রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অবস্থার উত্তরণে সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে এক বৈঠকে বিকল্প পন্থায় ঋণ আদায়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ঋণ আদায় করা যায়। বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করেও ঋণ আদায় করা হয়। কিন্তু বন্ধকি সম্পত্তির ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা জালিয়াতির আশ্রয় নিলে ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। অনেক সময় ব্যাংক পুনঃতফসিল, পুনর্বিন্যাস, নবায়ন ও মওকুফ সুবিধা দিয়ে ঋণ আদায় করে। তবে এসব সত্ত্বেও গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা না থাকলে তা আদায় করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ে বিকল্প উপায় খুঁজছে সরকার।
জানা গেছে, ব্যাংকিং বিভাগ খেলাপি আদায়ে চারটি বিকল্প ঠিক করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণ আদায় কর্মসূচি পালন, আদায়কারী কর্মীকে প্রণোদনা প্রদান, আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও বেসরকারি ডেট রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ। তবে রিকভারি এজেন্ট নিয়োগের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ আদায় পরিস্থিতি অত্যন্ত হতাশাজনক। এটি অব্যাহত থাকলে প্রতিষ্ঠানের ঋণ ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এ বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে বিকল্প পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এদিকে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন ব্যাংকাররা। এ বিষয়ে জিএম পদমর্যাদার একাধিক ব্যাংকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, নিয়ম মেনে ঋণ দেয়া হলে তা আদায় করা কঠিন কিছু নয়। ঋণগ্রহীতা তার জামানতের কারণেই ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু ভুয়া জামানত ও দুর্বল জামানত নিয়ে ঋণ দিলে সেক্ষেত্রে করার কিছুই থাকে না।
তবে বিকল্প পদ্ধতিতে ঋণ আদায়ের ধারণাকে অত্যন্ত সময়োপযোগী হিসেবে মনে করেন রূপালী ব্যাংকের এমডি এম ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব নীতিমালার অধীন বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের ভিত্তিতে রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছিল। অথচ এ বিষয়ে আইন না থাকায় তারা সফল হতে পারেনি। কিন্তু রিকভারি এজেন্ট নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে তা ধীরে ধীরে কার্যকর হবে।
জানা গেছে, ছয় বছর আগে বিভিন্ন ব্যাংক রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ শুরু করে। তখন ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকঋণ আদায়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল হওয়ায় তারা ঋণ আদায়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের ক্ষেত্রে আইনি ভিত্তি না থাকায় তারা এক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে। এছাড়া রিকভারি এজেন্টকে কাজ দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলেও বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় তাদের।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায়, ঋণখেলাপি মূলত দুটি কারণে হয়ে থাকে। এক দল হলো পরিকল্পিত খেলাপি, যারা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ যোগসাজশে জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হয়েছে। অন্য দলটি ব্যবসায়িক খেলাপি। দুর্যোগ, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, দুর্বল অবকাঠামো, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে তারা খেলাপি হয়েছে। আর এ খেলাপি আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো।
জানা গেছে, ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ ব্যবস্থায় ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণদানের সময় দুর্বল জামানত গ্রহণ, ভুয়া জামানত, বেনামে ঋণ ও জামানতের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান করা হয়। সর্বোপরি ঋণদানের ক্ষেত্রে শীর্ষ ব্যবস্থাপনার অনিয়ম, জালিয়াতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বেশির ভাগ ঋণ আর আদায়ের অবস্থায় নেই। এ কারণে স্বাভাবিক নিয়মে এ ঋণ আদায় আর সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থায় ঋণ আদায়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায়, গত জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, অগ্রণীর ৪ হাজার ৫০৬, বেসিকের ৪ হাজার ৩০৭, জনতার ৩ হাজার ৮২৫ ও রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
Leave a Reply