বেসিক ব্যাংকে জনবল নিয়োগ চিরকুটে পদ-পদবি নির্ধারণ করে দিতেন আবদুল হাই বাচ্চু
জেসমিন মলি | ২০১৫-১১-০৪ ইং
প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগই কেবল নয়; জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে চিরকুট লিখে পদ-পদবিও নির্ধারণ করে দিতেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। চেয়ারম্যানের নিয়মবহির্ভূত এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। আবদুল হাই বাচ্চুর সময় এভাবেই জনবল নিয়োগ ও পদায়ন হতো রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে।
জনবল নিয়োগে অনিয়মের এ চিত্র উঠে এসেছে বেসিক ব্যাংকেরই অভ্যন্তরীণ তদন্তে। গত ২৭ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে এ তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়। চেয়ারম্যানের নির্দেশনাযুক্ত জীবনবৃত্তান্তের একটি নমুনাও এর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়।
বেসিক ব্যাংকের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মের বাইরে গিয়ে এ পন্থায় ১ হাজার ৫৫৩ জনকে নিয়োগ দেন আবদুল হাই বাচ্চু। এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ৫৭ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির ব্যবস্থাও করেন তিনি।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি ২০১০ সালের এক সার্কুলারে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাহীর নিচে পরবর্তী দুই স্তর ছাড়া সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষমতা প্রধান নির্বাহীর ওপর ন্যস্ত থাকবে। পর্ষদের অনুমোদিত মানবসম্পদ নীতি ও জনবল মঞ্জুরির ভিত্তিতে চাকরিবিধি মোতাবেক প্রধান নির্বাহী এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবেন। পর্ষদ বা পর্ষদের কোনো কমিটির চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালক এতে সংশ্লিষ্ট হবেন না বা হস্তক্ষেপ করবেন না।’ অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিধি লঙ্ঘন করে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত বেসিক ব্যাংকের ২৭৪তম পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে উপমহাব্যবস্থাপক পদে (প্রধান নির্বাহীর তিন ধাপ অধস্তন পদ) জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা এককভাবে পর্ষদ চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
পদোন্নতিতে নিয়মভঙ্গের বিষয়টি উঠে এসেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ম্যাবস ও জে পার্টনারের প্রতিবেদনেও। এতে বলা হয়েছে, তত্কালীন চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বেআইনি, অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছেন। এ কর্মকাণ্ডের অনুমোদন দেয়ায় পুরো দায়ভার সাবেক চেয়ারম্যানের ওপর বর্তায়।
সংসদীয় কমিটিতে দেয়া ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালের জুলাইয়ে ১৪৬ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হলেও এজন্য পর্ষদ থেকে অনুমতি নেয়া হয় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। একইভাবে আরো ৩৬০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে। এজন্য অনুমোদন নেয়া হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে; যা ব্যাংকিং আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এসব নিয়োগের জন্য কোনো নিয়োগ কমিটিও গঠন করা হয়নি। কিছু নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিটি গঠন করা হলেও তা কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আব্দুর রাজ্জাক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ভুয়া সনদের মাধ্যমে বা বয়সসীমা পার হওয়া সত্ত্বেও যারা জালিয়াতি করে চাকরি নিয়েছেন, তাদের পদে বহাল রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ার এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাময়িক বরখাস্তকৃত সহকারী মহাব্যবস্থাপক ওয়ালিউল্লাহকে উপমহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকের গুলশান শাখায় ইনচার্জ হিসেবে পদায়ন করা হয়।
উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকের গুলশান শাখায়।
জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের এক আদেশে বলা হয়েছে, সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া নিয়োগ বা পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে কোনো কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটিতে আবশ্যিকভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করা হয়েছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকে নিয়োগের শর্তাবলি পরিপালন করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান শেষে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৬টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাইরে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হলেও বাইরে রয়েছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু।
Leave a Reply