৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠান

জেসমিন মলি | ২০১৫-১০-২৯ ইং

www.bonikbarta.com২০১০ সালের জুলাইয়ে আবাসন খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। সে সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহারেও আরোপ করা হয় শর্ত। তার ওপর বড় ধস নামে শেয়ারবাজারে। দেখা দেয় ক্রেতাপর্যায়ে ঋণের অভাব। এসব কারণে আবাসন খাতের বিক্রি কমে যায় ৫০ শতাংশের বেশি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে দেশের আবাসন খাত।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব বলছে, আবাসন খাতের বাজারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে শীর্ষ ২০ প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে বড় ২০ প্রতিষ্ঠান গত চার বছরে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হারিয়েছে।

আবাসন খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে— নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই), ইস্টার্ন হাউজিং, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এসইএল), শেলেটক, ডমইনো, কনকর্ড, শান্তা প্রপার্টিজ, সাউথ ব্রিজ, অ্যাশিউরেন্স, এএনজেড, আরবান ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, কমপ্রিহেনসিভ হোল্ডিংস লিমিটেড, অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেড, রূপায়ণ, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন, র্যাংগস প্রপার্টিজ, এনা প্রপার্টিজ, হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও বে ডেভেলপমেন্টস।

অবস্থা যখন খুবই খারাপ, তখন ফ্ল্যাটের দামে ছাড় দিয়ে মন্দা কাটানোর চেষ্টা চালায় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকঋণসহ আনুষঙ্গিক খরচ চালিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেয় তারা। কিন্তু তাতেও খুব একটা চাঙ্গা হয়নি বাজার।

রিহ্যাব সূত্র জানায়, সংগঠনের সদস্যদের ১২ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়ে গেছে। এর বাইরে আরো ১০ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হলেও ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি তা। ফলে এ খাতের প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা আটকে রয়েছে।

এদিকে ব্যবসা না থাকায় ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্প অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এ খাত ছেড়ে দিয়েছেন। আর প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোর পদক্ষেপে গত কয়েক বছরে চাকরি হারিয়েছেন আবাসন খাতের প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী। যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ নিয়ে তাদের প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিল, তাদের অবস্থা আরো খারাপ। ব্যাংকঋণের কিস্তির পাশাপাশি তাদের টানতে হচ্ছে সুদ। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার ব্যাংকখেলাপিও হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক তাদের অর্থ আদায় করতে এরই মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।

রিহ্যাবের সহসভাপতি (অর্থ) সরদার আমিন বলেন, আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের এ রকম দুর্দিন আগে কখনো আসেনি। সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়ার অভিযোগে অনেক ক্রেতাই আবাসন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। নীতিসহায়তার মাধ্যমে সহসাই এ পরিস্থিতির উন্নতি করা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

বিক্রি মন্দার বাইরেও অনেক ক্রেতা কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। অনেকে আবার ক্রয়াদেশও বাতিল করছেন। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ীকে ক্রেতাদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। মূলত এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। খাতের অনিশ্চয়তার কারণে নতুন কোনো প্রকল্পও নিচ্ছেন না তারা।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম. সেরাজ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, রিয়েল এস্টেট খাতের মন্দাভাব এ ব্যবসায় নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক বড় প্রতিকূলতা। বাংলাদেশে এ ব্যবসার জন্মলগ্ন থেকে এত দীর্ঘস্থায়ী এবং মারাত্মক দুরবস্থা কখনো হয়নি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি অবস্থা। সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কোনোভাবে টিকে আছে। তবে ছোট আকারের অনেক প্রতিষ্ঠানই এ ব্যবসা থেকে সরে গেছে।

তিনি বলেন, দেশের হাউজিং সেক্টরের বিকাশে এ ধারা অত্যন্ত নেতিবাচক। এ ক্রান্তিকালে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির চেয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তাই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এ মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬০০। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১২৪। অর্থাৎ এক বছরের অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ। এর আগে ২০১২ সালে অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৮৪।

২০১৪ সালে মাত্র ১ হাজার ৪৭৭টি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৬৩। অর্থাৎ ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে ২১ শতাংশ। আর ২০১২ সালে আবাসন ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে পেরেছিলেন ২ হাজার ২৯৩টি ফ্ল্যাট।

আবাসন ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে সবাই বিভিন্ন ধরনের ফ্ল্যাট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। তখন এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। কিন্তু সে অনুপাতে বিক্রি না বাড়ায় অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ক্রেতা আকর্ষণে দাম কমানো হলেও পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি।

এদিকে আবাসন খাতের মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য খাতও। এ খাতে জড়িয়ে আছে প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিক। এছাড়া রড, সিমেন্ট, ইট, বালি, গ্লাস, আসবাবসহ অনেক সহযোগী শিল্প এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। এরই মধ্যে বিভিন্ন খাতে আবাসন শিল্পের মন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সেসঙ্গে কমছে সরকারের রাজস্ব আয়ও।

 

Leave a Reply