বাগদা চিংড়ি চাষ উৎপাদন সাফল্যে পরিসর বাড়ছে আধা নিবিড় পদ্ধতির
মীর মনিরুজ্জামান ও জেসমিন মলি | ২০১৫-০৪-১৮ ইং
সাতক্ষীরার শ্যামনগর। গত বছর সেখানে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে এসেছে আশাতীত সাফল্য। সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে হেক্টরপ্রতি ৩০০-৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, সেখানে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে উৎপাদন পাঁচ হাজার কেজি ছাড়িয়ে যায়। একই ধরনের সাফল্য আসে জেলার আশাশুনি ও কক্সবাজারের খুরুস্কুল এলাকায়। এর পর থেকেই জনপ্রিয় হচ্ছে এ পদ্ধতি, যা রফতানি বাজারকে বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। এ থেকে এক লাখ টনের মতো চিংড়ি উৎপাদন হয়। সেখান থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রফতানি হয়। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব জমিতে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করা গেলে উৎপাদন বাড়বে ৫ থেকে ৭ গুণ। তখন চিংড়ি রফতানি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে। এজন্য দরকার সরকারি সহায়তা। কেননা সনাতন পদ্ধতির তুলনায় আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে খরচ কিছুটা বেশি।
চিংড়ি উৎপাদকরা জানান, সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে হেক্টরপ্রতি খরচ হয় ৫০ হাজার থেকে সোয়া ১ লাখ টাকা। অন্যদিকে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এ কারণে অনেক সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও এখনো খুব একটা বিস্তার ঘটেনি আধা নিবিড় পদ্ধতির। বর্তমানে এ পদ্ধতিতে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে।
এদিকে চিংড়ি চাষে নীতিগত সহায়তা দিতে উদ্যোগ নিয়েছে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সহজ শর্তে ও কম সুদে চাষীদের ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিষয়টি আমলে নিয়ে কৃষি ঋণ নীতিমালায় চিংড়ি চাষকে বিশেষ প্রাধান্য দিতে নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগও নিয়েছে। পাশাপাশি গাভী পালন ও চিংড়ি চাষে ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের জন্য অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি আমিন উল্লাহ বণিক বার্তাকে জানান, পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যক্তি উদ্যোগে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে উৎপাদন বেড়েছে। নব্বইয়ের দশকে চাষ শুরু হলেও সে সময় বেশকিছু দুর্বলতার কারণে এ প্রকল্প ব্যর্থ হয়। অতীতের সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে সফলতা পাওয়ায় সবাই এ পদ্ধতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
বিএফএফইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সনাতন পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক ব্যয়বহুল হওয়ায় আমরা স্বল্প সুদে ঋণের আবেদন করেছি কাছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ আরো বাড়বে। একই সঙ্গে রফতানি আয়েও প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখবে।
মূলত পাইলট প্রকল্প হিসেবে সাতক্ষীরায় খুব অল্প পরিসরে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়। জেলার অন্যতম চিংড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আশাশুনি উপজেলার তেঁতুলিয়ার সীতারা ফিশ ফার্ম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী খায়রুল মোজাফ্ফার মন্টু প্রথম সেখানে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সাফল্য পান। তিনি জানান, বর্তমানে ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করছেন। আগে যেখানে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে, এখন আধা নিবিড় পদ্ধতি অনুসরণ করে একই জায়গায় পাঁচ হাজার কেজির বেশি উৎপাদন হচ্ছে।
জেলা মত্স্য অধিদফতর সূত্র জানায়, এ জেলায় ৫০ হাজার হেক্টরের অধিক জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২ হাজার টন। আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে
বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ যেখানে নেই, সেখানে ইঞ্জিনচালিত মেশিনের সাহায্যেও চাষ করা যায়।
সাতক্ষীরা জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মো. আবদুল ওদুুদ বলেন, অল্প জমিতে অধিক উৎপাদনের জন্য এ প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। এরই মধ্যে পদ্ধতিটি জেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে সাতক্ষীরার বহু চাষী এ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। পদ্ধতিটি জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে রফতানিজাত চিংড়ি শিল্পে বিপ্লব সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি।
বাগদা চিংড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নওয়াবেকী রেডিয়েন্ট শ্রিম্প কালচারের মালিক সফিকুর রহমান চৌধুরী জানান, উন্নত প্রযুক্তিতে বাগদা চিংড়ি চাষের লক্ষ্যে তিনি থাইল্যান্ড থেকে আধা নিবিড় পদ্ধতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। চিংড়ি উৎপাদনের পাশাপাশি নওয়াবেকী এলাকায় একটি পোনা উৎপাদনের হ্যাচারিও স্থাপন করেন। পিসিআর ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করায় তার পোনার চাহিদাও বেশি।
আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি চাষে সাফল্য অর্জনকারী আরেক চিংড়িচাষী সাতক্ষীরার দেবহাটা এলাকার লাভলু হোসেন। তিনি জানান, তাদের এ সাফল্য দেখে এ অঞ্চলের চিংড়িচাষীরা অল্প জমিতে অধিক উৎপাদনের আশায় আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গোলাম সরোয়ার
Leave a Reply