কনডেনসেট পরিশোধন জ্বালানি আমদানি সাশ্রয়ী প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাগ্রহ
মীর মনিরুজ্জামান ও জেসমিন মলি | ২০১৫-০৮-০৬ ইং
কেরোসিন ও অকটেনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে সিলেটের রশিদপুরে দুটি জ্বালানি পরিশোধন প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ২০১৬ সালে। যদিও তিন বছরেও ভূমি উন্নয়নই শেষ হয়নি। ভূমি উন্নয়নের প্রায় অর্ধেক কাজ এখনো বাকি। তাই ঘোষিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ভূমি উন্নয়নকাজ শেষ হওয়া নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। অথচ প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি আমদানি বাবদ বছরে সাশ্রয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা।
সূত্রমতে, প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নে কোনো সমস্যা নেই। নেই উন্নয়ন সহযোগীদের শর্তের বেড়াজালও। তার পরও একটি মহলের অনীহার কারণে দীর্ঘ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির নজরে এসেছে বিষয়টি। প্রকল্প কাজের ধীরগতি নিয়ে তারাও প্রশ্ন তুলেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়েই। এক পক্ষ চাইছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন বাড়াতে। অন্য পক্ষ চায় কনডেনসেট রফতানি করে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করতে। আরো একটি পক্ষ আছে, যারা বেসরকারি রিফাইনারি মালিকদের কাছেই কনডেনসেট বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী। এ টানাপড়েনের কারণেই প্রত্যাশিত অগ্রগতি নেই প্রকল্পে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সে সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাই আমরা। এজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
সিলেটের রশিদপুরে দৈনিক চার হাজার ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্ন কনডেনসেট পরিশোধন প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০১২ সালে। দৈনিক তিন হাজার ব্যারেল অকটেন পরিশোধনের প্রকল্পটিও গ্রহণ করা হয় একই বছর। সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন বলছে, দুটি প্রকল্পের ৫২ শতাংশ ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। একটি প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ হলেও আরেকটি দরপত্রই চূড়ান্ত হয়নি। অথচ প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন পাঁচ হাজার ব্যারেল নিজস্ব জ্বালানি পাবে সরকার। এ সম্ভাবনা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. আবুবকর সিদ্দিক বলেন, প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রস্তুতি নিতে কিছুটা বাড়তি সময় ব্যয় হয়েছে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়তো কাজ শেষ হবে না। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে।
জানা গেছে, দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে সহজাত হিসেবে কনডেনসেট পাওয়া যায় প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ব্যারেল। কিছু কনডেনসেট সরকারিভাবে পরিশোধন করা হয়। কিছু পরিশোধন করা হয় বেসরকারিভাবে। কিন্তু বেসরকারি রিফাইনারিগুলো সঠিকভাবে পরিশোধন না করেই জ্বালানি বাজারে ছাড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন যানবাহন ব্যবহারকারীরা। এজন্য সরকারিভাবে কনডেনসেট পরিশোধনের জন্য প্রকল্প দুটি হাতে নেয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বাইরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নতুন কোনো পরিশোধন কেন্দ্র হোক, তা চায় না জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি পক্ষ। এ নিয়ে পেট্রোবাংলা ও বিপিসির মধ্যে রয়েছে টানাপড়েন। সিলেট গ্যাসফিল্ডের পরিশোধিত জ্বালানি কেনার বিষয়েও আগ্রহ কম বিপিসির। তাদের যুক্তি, কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত অকটেন মানসম্পন্ন হবে না।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এএম বদরুদ্দোজা বলেন, দেশে অকটেনের চাহিদা বছরে দুই লাখ টন। এটা আমদানি করা হয়। সিলেট গ্যাসফিল্ড যদি বিপিসির মানের অকটেন উৎপাদন করে, তাহলে তা কিনতে কোনো সমস্যা হবে না।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রশিদপুরে দৈনিক চার হাজার ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্ন কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট স্থাপনে প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৯৬ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পটিতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ ব্যারেল পেট্রল, ৮৪০ ব্যারেল কেরোসিন ও ৩৬০ ব্যারেল ডিজেল পরিশোধন হবে।
এছাড়া পেট্রল রিফাইন করে অকটেনে রূপান্তরের জন্য রশিদপুরে দৈনিক তিন হাজার ব্যারেল ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যাটালাইটিক রি-ফর্মিং ইউনিট স্থাপন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯৬ কোটি টাকা। দুটি প্রকল্পই বাস্তবায়নের দায়িত্বে সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন নিয়ে গত দুই বছর অনেক ঝামেলা গেছে। কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্টের দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। প্লান্ট স্থাপনের কাজ পেয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইস্তানা কারাং লাউট ও এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। প্লান্ট স্থাপনে ব্যয় হবে ৩৩৭ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ব্যয় হবে ভূমি উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে। ক্যাটালাইটিক রি-ফর্মিং ইউনিটের প্লান্ট স্থাপনে ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে।
সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুরুতে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। এ কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে। তাছাড়া সিলেট গ্যাসফিল্ড আগে এ ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি। অভিজ্ঞতার অভাবে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প দুটির কাজ সম্পন্ন হবে।
Leave a Reply