বেসিক ব্যাংকে অনিয়ম আবেদন না করেই ঋণ!
জেসমিন মলি ও সাকিব তনু | ২০১৫-০২-১৭ ইং
আবেদন না করেও ঋণ পেয়েছেন অনেকে। ঋণ আবেদনের নির্ধারিত ফরমও ছিল না। নিজেদের সুবিধামতো তথ্য দিয়েই অর্থ পেয়ে গেছেন গ্রাহকরা। মঞ্জুরিকৃত ঋণের অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কেনা হয়েছে জমি। সেই জমিই আবার জামানত হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। নজিরবিহীন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত।
অনিয়মের এসব তথ্য উঠে এসেছে ফাংশনাল অডিট প্রতিবেদনে। এটি তৈরি করেছে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠান মেসার্স হালিম খায়ের চৌধুরী; অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় যা তুলে ধরা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে সংঘটিত এ অনিয়মের কারণে সব সূচকেই অবনতি হয়েছে ব্যাংকটির। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পড়েছে মূলধন ঘাটতিতেও। সর্বোপরি একসময় মুনাফায় থাকা ব্যাংকটির বেড়েছে লোকসানের পরিমাণ।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ছিল ৬৫ কোটি টাকা। আর ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত সময়ে যে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা চেষ্টা করছি ব্যাংকটিকে ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে। এ সময়ে সূচকের বড় কোনো উন্নতি হয়নি। কিছু ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ফলে শ্রেণীকৃত ঋণ কিছুটা কমেছে। চেষ্টা করা হচ্ছে ব্যাংকটিকে ভালো করে তোলার।’
অনিয়ম উদ্ঘাটনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও বেসিক ব্যাংকের সার্বিক কার্যাবলির ওপর ওই ফাংশনাল অডিট পরিচালনা করা হয়। তাতে অনিয়মের বিস্তারিত উঠে আসে। অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেতিবাচক বিষয়গুলো গোপন রেখে বোর্ডের কাছে ঋণ প্রস্তাব পেশ করা হয়। ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের জাল দলিলও বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। গ্রাহকের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য ও ব্যবসাস্থল পরিদর্শন না করেই ঋণ প্রস্তাব পেশ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হালনাগাদ সিআইবি রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। যাচাই-বাছাই না করে তড়িঘড়ি চলতি হিসাব খুলে স্বল্প সময়ে এমনকি একদিনের মধ্যেই অনুমোদনের জন্য শাখা কর্তৃক ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ঋণ বিতরণ নীতিমালা উপেক্ষা করে জামানত ব্যতীত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণও করা হয়। এসব অনিয়মের কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বেসিক ব্যাংক।
বেসিক ব্যাংক থেকে নেয়া এ অর্থকে কোনোভাবেই ঋণ বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক থেকে সংঘবদ্ধ চক্র অর্থ বের করে নিয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের এতে সায় ছিল। সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতি ভেঙে এসব অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে।
ব্যাংকটিতে ২০১৪ সালে ১৪০টি একক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ৭ হাজার ৯৫৫ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৬৯২ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের ফান্ডেড ঋণের তুলনায় এটা ১৭ গুণ বেশি। এ সময় ব্যাংকের মূলধন ঋণাত্মক হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহদাঙ্ক ঋণ হিসাবের জন্য শুধু পরিশোধিত মূলধনকে ভিত্তি ধরার নির্দেশ দেয়। এতে বৃহদাঙ্ক ঋণের সিলিং কমে যাওয়ায় এত বেশি সংখ্যক গ্রুপ বা গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বৃহদাঙ্ক ঋণে পরিণত হয়।
২০১২ ও ২০১৩ সালে ব্যাংকের শান্তিনগর, গুলশান ও দিলকুশা শাখায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম সংঘটিত হয়। এর পর গত বছরের ২৫ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। ২৯ মে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, আর্থিক অনিয়মের দায় পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারে না। তাই এ পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্ষদ বাতিল করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চেয়ারম্যানের পদ থেকে গত বছরের ২ জুলাই সরে দাঁড়ান শেখ আব্দুল হাই।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। এখনো এ অনুসন্ধান চলছে।
এদিকে ব্যাংকটির সাবেক ডিএমডি ও জিএমসহ চারজনের বিরুদ্ধে চলতি মাসে পাঁচটি মামলা করেছে দুুদক। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন— বেসিক ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি (বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত) মোনায়েম খান, সাবেক জিএম ও শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী এবং তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়।
Leave a Reply