দুদকের অর্থ পাচার অনুসন্ধান ৮১.৬৭% অভিযোগই অনিষ্পন্ন
জেসমিন মলি | ২০১৪-০৬-২০ ইং
অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে মামলা করলেও সেসব মামলায় বড় কোনো অর্জন নেই। গত তিন বছরে অর্থ পাচারসংক্রান্ত ৩৭১টি অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। এর মধ্যে ১৪০টির ক্ষেত্রে মামলা হয়। তবে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬৮টি। সে হিসাবে ৮১ দশমিক ৬৭ শতাংশ অভিযোগই অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৩ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জনবল সংকটের কারণেই মামলা নিষ্পত্তির হার কম বলে দাবি করলেও বিশেষজ্ঞরা এজন্য দুদকের সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক দুদকে অর্থ পাচারের অভিযোগ পাঠায়। তবে দুদক এসব অভিযোগ নিষ্পত্তিতে কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এম মাহফুজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ পাচার রোধে আমাদের পৃথক সেল কাজ করছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযোগ থাকায় তা সহজেই ধরা পড়ছে। পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা এসব অভিযোগ
তথ্য-প্রমাণসহ দুদকে পাঠিয়ে থাকি।
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে কমিশন অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্ব দিয়েছে। একই বছর ১৮০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা আগের দুই বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি। ২০১১ সালে ৪৪টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়। তার পরের বছর ৩৯টি অভিযোগ গৃহীত হয়।
২০১৩ সালে কমিশন ৪৭টি অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে ৩৯টির অভিযোগপত্র দাখিল করে। সে বছর কমিশন পরিচালিত তদন্তের সংখ্যা ছিল ১৮৬। এসব তদন্তের মধ্যে ১১৩টি নতুন ও ৭৩টি পূর্ববর্তী বছরের। ওই বছর এ-সংক্রান্ত অভিযোগের মাত্র ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ মামলার তদন্ত শেষ করতে সমর্থ হয় সংস্থাটি।
২০১২ সালে কমিশন ৬৮টি নতুন অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে এবং আগের বছরের ৩৪টি অনিষ্পন্ন তদন্তের কাজ করে। মোট ১০২টি মধ্যে ২৯টির তদন্ত সম্পন্ন করে কমিশন। এর মধ্যে ২৫টির অভিযোগপত্র দাখিল করে তারা। ২০১২ সালে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ মামলার তদন্তকাজ শেষ হয়।
২০১১ সালে ৪১টি অর্থ পাচারের তদন্তের মধ্যে নয়টির তদন্ত সম্পন্ন হয় এবং ৮টির অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সে বছর ২২ শতাংশ মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে পারে কমিশন।
মামলার উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে না পারলেও অর্থ পাচার রোধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সহায়তা বাড়িয়েছে কমিশন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে এসব সংস্থার সঙ্গে দুদকের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে অর্থ পাচারের নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। এসব অর্থ পাচার রোধে মোবাইল ব্যাংকিংকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলা হয়। এজন্য অনিবন্ধিত সিম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরো কঠোর হতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) সুপারিশ জানায় তারা।
পাচারকারীরা এত দিন অবৈধ ব্যাংকিং, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা ও কুরিয়ারে লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে এলেও সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। দেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশী নাগরিকদের মাধ্যমে এ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুদক ও বিএফআইইউ যৌথভাবে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী দুদক কর্মকর্তারা কাজ করেন। তাদের সহায়তা করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা।
অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশও বিদেশে পাচার করা হয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ২০১২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ১ লাখ ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার করা এসব অর্থ দেশে ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় দুদক বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও সে অর্থে কোনো সফলতা নেই।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধে কমিশনের সক্রিয়তা বাড়ানো হয়েছে। বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আমাদের অনেক কার্যক্রম দৃশ্যমান হয় না। এর মানে আমাদের সফলতা নেই, তা ঠিক নয়। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থ ফেরতও এসেছে। ভবিষ্যতে পাচারকৃত আরো অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।’
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক খাতকে গতিশীল করতে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০৯-এ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে ঘুষ ও দুর্নীতিকে সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
Leave a Reply