ক্রেতা সংকট রাজধানীর অভিজাত এলাকায় জমির দাম কমছে
জেসমিন মলি | ২০১৪-০৭-১৮ ইং
গত বছর পর্যন্তও রাজধানীর অভিজাত এলাকায় জমির দাম বাড়ে ধারাবাহিক গতিতে। এক দশকের ব্যবধানে তা ১০ গুণ ছাড়িয়ে যায়। তবে চলতি বছর থেকে দেখা যাচ্ছে বিপরীত প্রবণতা। ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমির দাম কমেছে ১৭ থেকে ২৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবাসন কোম্পানির পাশাপাশি অভিজাত এলাকায় জমির ক্রেতা বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। এসব এলাকার জমির দাম মাঝে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তাদের অনেকেই দেশের বাইরে জমি কেনায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এক্ষেত্রে এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে অভিজাত এলাকায় জমির ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে এর দামে। তার পরও এসব এলাকার জমির দাম এখনো অনেক বেশি বলে মনে করছেন তারা।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডিতে জমির দাম কমেছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৩ সালে এ এলাকায় প্রতি কাঠা জমি ৪ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও এ বছর তা ৩ কোটিতে নেমে এসেছে। অর্থাত্ গত বছরের তুলনায় অভিজাত এলাকাটিতে জমির দাম কমেছে ২৫ শতাংশ। আরেক অভিজাত এলাকা গুলশানে জমির দাম কমেছে ২০ শতাংশ। গত বছর এ এলাকায় প্রতি কাঠা জমি গড়ে ৫ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও এখন হচ্ছে ৪ কোটিতে।
একইভাবে জমির দাম পড়তির দিকে রাজধানীর আরো তিন অভিজাত এলাকা বারিধারা, বনানী ও লালমাটিয়ায়। বারিধারায় বর্তমানে প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৫ কোটি টাকায়। গত বছর এর দাম ছিল ৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে এলাকাটিতে জমির দাম কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। অথচ ২০০০ সালেও বারিধারায় প্রতি কাঠা জমি লেনদেন হতো গড়ে ৫০ লাখ টাকায়।
তথ্যমতে, বনানী এলাকায় প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে ৩ কোটি টাকায়। ২০১৩ সালে একই জমি বিক্রি হয় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। অর্থাত্ গত বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ কমে বিক্রি হচ্ছে এ এলাকার জমি। আর লালমাটিয়ায় গত বছর যে জমি (প্রতি কাঠা) আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তা নেমে এসেছে ২ কোটিতে। এ হিসাবে রাজধানীর অভিজাত এ এলাকায়ও জমির দাম কমেছে ২০ শতাংশ।
দাম কমার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্রেতা না থাকায় অনেক ফ্ল্যাট এখনো অবিক্রীত পড়ে আছে। এ কারণে নতুন প্রকল্পে আগ্রহী হচ্ছেন না আবাসন ব্যবসায়ীরা। এতে জমির বাজারেও ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। তারই প্রভাব পড়েছে এর দামে।
আবাসন কোম্পানি শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম সেরাজ বলেন, ‘অ্যাপার্টমেন্টের বাজারে ক্রেতা নেই। কয়েক দফা দাম কমিয়েও অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করতে পারছি না। বুকিং বাতিলের ঘটনাও ঘটছে। গুলশান-বারিধারা এলাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি একেবারেই পড়ে গেছে। মন্দা বাজারে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। এ কারণে জমির দামও কমছে। তবে এখনো দাম তুলনামূলক বেশি।’
জমির দাম নির্ধারণে সরকারের কোনো নীতিমালা নেই। এ কারণেও জমির দামে অস্বাভাবিক ওঠানামা করে বলে মনে করছেন অনেকে।
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. গোলাম রব্বানী বণিক বার্তাকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ক্রেতা-বিক্রেতা সমঝোতার ভিত্তিতেই জমির দাম নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার থাকে না। তবে দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, অভিজাত এলাকায় জমির দাম বাড়তে বাড়তে একসময় তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে। দামের এ উল্লম্ফনে ক্রেতা চাহিদাও কমতে থাকে। ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান-বারিধারায় জমির দাম কিছুটা কমলেও ক্রেতা সংকট এখনো রয়েই গেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, তারল্য সংকটের কারণে ফ্ল্যাট বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। নগদ অর্থের মালিকরাও টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও দুদক ও এনবিআরের জেরার ভয়ে অনেকেই এ সুযোগ নিতে চান না। এসবেরই প্রভাব পড়েছে জমির দামে।
সূত্রমতে, ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমির দাম অন্য অনেক দেশের চেয়েই বেশি। এ কারণে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অনেকে গুলশান-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার পরিবর্তে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে বেছে নিচ্ছেন বাইরের দেশকে। এক্ষেত্রে এজেন্ট হিসেবেও কাজ করছেন কেউ কেউ। গত বছরও বাংলাদেশীদের কাছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির চেষ্টা চালায় দামাক প্রপার্টিজ। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে বাংলাদেশীদের বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে বিধিনিষেধ থাকায় পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাকেও জমির দাম কমার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, ধনী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীই ঢাকার অভিজাত এলাকার জমির ক্রেতা। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে তাদের হাতে অর্থের পরিমাণ সে রকম নেই। এ কারণে জমির চাহিদা পড়তির দিকে। আর চাহিদা না থাকায় এসব এলাকার জমির দামও কমছে।
Leave a Reply