জরিমানা আদায়েও শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে
যানজট নিরসন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতি বছরই জরিমানা আদায়ের হার বাড়ছে। গত আট বছরে রাজধানীতে শুধু ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণেই বিভিন্ন যানবাহনের মালিক ও চালকের কাছ থেকে ২১৭ কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না সড়কে। যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিংসহ ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা থেকে বেরোতেই পারছে না রাজধানীবাসী।
রাস্তায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনার জন্য ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অমান্যের কারণে মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রসিকিউশন দাখিল করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক আইন অমান্য করে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন থেকে জরিমানা আদায় করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (জননিরাপত্তা বিভাগ) গত আট বছরে ট্রাফিক আইন ভাঙার কারণে বিভিন্ন যানবাহন থেকে জরিমানা আদায়ের একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ট্রাফিক আইন অমান্য করার দায়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৯৯ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৮ কোটি ৫৩ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৩ কোটি ২৫ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৮ কোটি ৫৪ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৬ কোটি ১৬ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত জরিমানা আদায়ের পরও প্রতিনিয়ত ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনা ঘটে চলেছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেলী ফেরদৌস বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের এখানে শুধু অর্থদণ্ড দেয়া হয়। যে পরিমাণ অর্থদণ্ড দেয়া হয়, তা খুবই সামান্য। কিন্তু বিশ্বের অনান্য দেশে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীকে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি পয়েন্ট কেটে নেয়াসহ নানাভাবে দণ্ডিত করা হয়। আমাদের এখানেও ওই পদ্ধতি চালু করা গেলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ চালকই শিক্ষিত নন। এ কারণে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ওই অর্থে সচেতনতা তৈরি করা যাচ্ছে না। তার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে বরাবরই চালকদের নিয়ে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসহনীয় যানজটের কারণেও ঢাকার গাড়িচালকরা যেকোনো উপায়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন। আর এটি করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করা হয় ট্রাফিক আইন ও রাস্তার শৃঙ্খলা। নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে কত সময় লাগবে, তা আগে থেকে বলা ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অসম্ভব। সকাল হোক আর দুপুর, বিকাল হোক আর সন্ধ্যা, কখনই বলা যাবে না, কতটুকু সময়ের মধ্যে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব। এর কারণ ঢাকা শহরের যানজট। যানজট নিরসনে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এ শহরের যানজট না কমে উল্টো বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বলেন, ঢাকা শহরের যানজট ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২০০৪ সালে মহাপরিকল্পনা (এসটিপি) গ্রহণ করা হলেও তার কোনো নির্দেশনাই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে ঢাকার যানজটকে স্থায়ী রূপ দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ঢাকায় দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তা না হলে ১০ বছরের মধ্যে ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহর।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ট্রাফিক পূর্ব ও ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগীয় এলাকায় যানজটের কারণ হিসেবে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় খানাখন্দ তৈরি হওয়ায় যানবাহনের স্বাভাবিক গতি কমে যায়। প্রতিবেদনে সমাধানের বিভিন্ন উপায়ও তুলে ধরেছে ট্রাফিক বিভাগ। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। এতে যানজটের ১৬২টি স্পটের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে চালক ও পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানা, ফুটপাত দখল, অবৈধ পার্কিং, রাস্তার ওপর ময়লার কনটেইনার, রাস্তায় ট্রাক ও পিকআপে মালপত্র লোড-আনলোডসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করতে রাস্তা সম্প্রসারণ, নির্ধারিত স্থানগুলোর ভূমিতে ইউলুপ নির্মাণ, ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করা, বাসস্টপগুলো যুক্তিসঙ্গত জায়গায় পুনর্বিন্যাস করা, কোম্পানি বা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাস পরিচালনা করা, নির্ধারিত সড়কগুলোয় বে-পদ্ধতি চালু এবং নির্মিত বাস টার্মিনালগুলোকে পিপিপি মডেলে বহুতল বাস টার্মিনালে রূপান্তরের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া চালকদের শারীরিক ও মানসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে উচ্চহারে জরিমানা আদায়, গাড়িতে পতাকা, ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্টিকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং উল্টো রাস্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বনের জন্য কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
Leave a Reply