নিরীক্ষা আপত্তি তিতাসে ৫ বছরে গরমিল ৩ হাজার কোটি টাকার
যথাযথভাবে আর্থিক বিধি অনুসরণ করা হয়নি। রয়েছে ক্রয় ও বকেয়া-সংক্রান্ত আপত্তি। আবার সিস্টেম লসের দোহাই দিয়েও আদায় হয়নি বড় অঙ্কের অর্থ। অনাদায়ী রয়েছে জামানতও। এ রকম ২৩৩ অডিট আপত্তি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নিয়ে। ২০১০-১১ থেকে পরবর্তী পাঁচ অর্থবছরের এসব নিরীক্ষা আপত্তিতে প্রায় ৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকার গরমিল উঠে এসেছে। সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী মিটির বৈঠকে এসব আপত্তি উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অদক্ষতার কারণেই এত বড় অঙ্কের অডিট আপত্তি উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শওকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিতাসে ৩৭২টি অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। অথচ ২০১০-১১ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এত বড় অডিট আপত্তি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে এর আগে দেখা যায়নি। সঠিক সময়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এত বিপুল অঙ্কের আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।
তিনি জানান, বিধি অনুযায়ী যথা শিগগিরই সম্ভব এসব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অডিট অধিদপ্তরের প্রতি।
তিতাসের ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের নিরীক্ষা আপত্তির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠেছে ২৫টি। ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠেছে ১৫টি। ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত ব্যয়ে আপত্তি ২৬টি। আর ১৫ লাখ থেকে তার ঊর্ধ্বে ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠেছে ১৬৫টি। এভাবে মোট ২৩৩টি অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ১৩৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর বাইরে গত পাঁচ বছরে ২১টি অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যাতে অর্থ আদায় হয়েছে ১২০ কোটি টাকা।
অডিট অধিদপ্তর তিতাসের শ্রেণীভিত্তিক আপত্তিতে আরো যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে ক্রেডিট ব্যালান্স ও নন-পোস্টেড ভাউচার-সংক্রান্ত চারটি আপত্তি উঠেছে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪২৭ কোটি টাকা। উত্সাহ বোনাস-সংক্রান্ত তিনটি আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা। চুরি ও ঘাটতি, ছুটি নগদীকরণ, মন্ত্রণালয় কর্তৃক কোম্পানির গাড়ি ব্যবহার, কোম্পানি কর্তৃক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর প্রদান, বিদেশে প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত আপত্তিতেও বড় অঙ্কের অর্থের গরমিল রয়েছে।
দুর্নীতি আর অদক্ষতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে সিস্টেম লসে পড়ে তিতাস। সে বছর তিতাসের সিস্টেম লস ছিল দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছরে তা আরো বেড়ে যায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিতাসের সিস্টেম লস দাঁড়ায় দশমিক
এরপর ্ব পৃষ্ঠা ২ কলাম ১
৩২ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যদিও ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম গেইন ছিল ১ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে সিস্টেম গেইন ছিল ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। সিস্টেস লস অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছর তিতাসের গ্যাসের বড় একটি অংশ অপচয় হয়।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তিতাসের গ্যাস ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬০৪ কোটি ৯৫ লাখ ঘনফুট। আর বিক্রি করা হয় ১ হাজার ৫৪১ কোটি ৬৯ লাখ ঘনফুট। অর্থাত্ গ্যাস অপচয় হয় ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ঘনফুট গ্যাস। আর এতে সংস্থাটির মুনাফা বড় অংশ হ্রাস পায়। তবে অবৈধ সংযোগকে গ্যাস অপচয়ের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ না পেয়ে অনেকেই তিতাসের গ্যাস অবৈধভাবে ব্যবহার করছে।
এদিকে তিতাসে বড় অঙ্কের অর্থ অনাদায়ী রয়ে গেছে এখনো। এর বাইরে আয়ও কমেছে। সিস্টেম লস বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে আয়ে। ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে কোম্পানিটিতে যে পরিমাণ কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে, তা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয় বেড়েছে। ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে তিতাসের আয় হয় ৮ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৯০ কোটি টাকা বেশি। যদিও সিস্টেম লসের কারণে কোম্পানির পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায় সে সময়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে কোম্পানির আয়ের বিপরীতে বিক্রি বাবদ খরচ ছিল ৮৩ শতাংশ, যা ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে প্রায় ৮৬ শতাংশে উন্নীত হয়। একই সময়ে প্রশাসনিক ও পরিচালন ব্যয়ও ৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাব বছরে অন্যান্য আয় বাড়লেও কমেছে কর ও সুদ বাবদ ব্যয়। ওই হিসাব বছরে তিতাসের কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ৮৮৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩৮ কোটি টাকা কম। মুনাফা কমে যাওয়ায় লভ্যাংশ ঘোষণায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে কোম্পানিটি মাত্র ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
Leave a Reply