বিলুপ্তপ্রায় দেশী মাছ ফিরে আসছে
জেসমিন মলি | ২০১৫-১২-১১ ইং
একসময় হালদা থেকে ডিম সংগ্রহের পর তা ফোটানো হতো সনাতনী পদ্ধতিতে, মাটির কুয়ায়। এ পদ্ধতিতে ডিম থেকে রেণু সংগ্রহ করা যেত সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। হালদার তীরবর্তী অঞ্চলে এখন গড়ে উঠেছে সাতটি আধুনিক মত্স্য হ্যাচারি। এসব হ্যাচারিতে সংগৃহীত ডিম থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত রেণু উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এর মধ্যে আছে বিলুপ্তপ্রায় অনেক দেশী প্রজাতির মাছও।
পাঁচ বছর ধরে শিং মাছের চাষ করছেন সাতক্ষীরা সদরের ভাড়ুখালী এলাকার খামারি রাজীব হোসেন। গেল বছর ১০ বিঘা পুকুরে শিং চাষ থেকে মুনাফা পেয়েছিলেন ৮ লাখ টাকার মতো। চলতি মৌসুমে বিলুপ্তপ্রায় এ মাছের চাষ করেছেন ১৫ বিঘা জমিতে। আগামীতে চাষের আওতা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবেই ফিরে আসছে বিলুপ্তপ্রায় দেশী প্রজাতির মাছ। এসব মাছের মধ্যে শিং যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে আছে বাটা, সরপুঁটি, ভাঙগনা, কালিবাউশ, গনিয়া, মহাশোল, পাবদা, মাগুর, চিতল ও ফলি। মত্স্য অধিদফতর বলছে, বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছের প্রজনন ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মত্স্যচাষী, বেকার যুবক ও যুব মহিলা এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ বাজারে বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছের প্রাপ্যতা বেড়েছে।
তথ্যমতে, ২৭০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায় দেশে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) হিসাবে, এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সংখ্যা ৫৪।
বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বাড়াতে ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্পের আওতায় ১৮টি জলাশয়ে ব্রুড মাছ ও পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ব্রুড মাছ অবমুক্ত করা হয়েছে প্রায় ১০ প্রজাতির ১ হাজার ৬৬১ কেজি। আর পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে ২৮৮ কেজি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মত্স্য অধিদফতর।
মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, দেশী মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের সুফল পাওয়া গেলে দেশীয় বিপন্ন প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা আরো বাড়বে, দামও সহনশীল হবে। এছাড়া দেশী প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়ানো গেলে ভারত ও মিয়ানমার থেকে মাছ আমদানিও কমে আসবে।
মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দৈনিক জনপ্রতি ৬০ গ্রাম প্রাপ্যতা ধরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাছের চাহিদা ধরা হয়েছে ৪০ লাখ ৫৫ হাজার টন। এর বিপরীতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টন।
বাকি চাহিদা পূরণে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মিয়ানমার ও ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাছ আমদানি করতে হয় প্রতি বছর। গত অর্থবছরও দেশে মাছ আমদানি হয় ৯৭ হাজার ৩৮৪ টন। আমদানিকৃত এ মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, বোয়াল প্রভৃতি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে দেশী প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।
মত্স্য অধিদফতরের সূত্রমতে, দেশী প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলাশয় ভরাট ও দূষণ রোধের পাশাপাশি মাছের অতি আহরণ ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ বন্ধ করা। এছাড়া উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত পাঁচ বছরে পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে ৪ হাজার ৩০২ টন। এর মধ্য দিয়ে অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের পুনরাবির্ভাব ঘটবে বলে জানান মত্স্য কর্মকর্তারা।
মত্স্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, এ কার্যক্রম পরিচালনার ফলে দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে বছরে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন হবে বছরে প্রায় দুই হাজার টন। পাশাপাশি আয় বাড়বে জলমহালের ওপর নির্ভরশীল জেলে ও মত্স্যজীবীদের। সেই সঙ্গে অনেকাংশ বাড়বে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ।
জানা গেছে, দেশী প্রজাতির ছোট মাছের প্রজাতি সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য ৩৮টি জেলার ৭৫টি উপজেলার ১৩৬টি প্রাকৃতিক জলাশয় পুনঃখনন করা হয়েছে। এসব জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে ১৫৪ টন। ৫৭টি সরকারি মত্স্যবীজ উৎপাদন খামারে দেশী প্রজাতির ছোট মাছের কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশী প্রজাতির মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৬ জন চাষীকে।
দেশী প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়াতে কাপ্তাই লেকে প্রজনন মৌসুমে তিন মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ লেকের বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে রয়েছে মহাশোল, শিলং, দেশী সরপুঁটি, মহিনী বাটা, বাঘ আইড়, ঘাওরা, সাদা ঘনিয়া, তেলে গুলশা, ফ্যাইসা, পোয়া, মধু ও পাবদা।
বিলুপ্তপ্রায় দেশী প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক শহীদুর রহমান। তিনি বলেন, এসব উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সে লক্ষ্যে তদারকি বাড়াতে হবে।
Leave a Reply