সরকারি সব সহযোগিতা নিয়েও এগোতে পারছে না বিমান
জেসমিন মলি ও মনজুরুল ইসলাম | ২০১৫-১২-২৪ ইং
গত পাঁচ বছরে কেনা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন ছয়টি বোয়িং উড়োজাহাজ। লিজ নেয়া হয়েছে আরো চারটি। পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে নতুন বৈমানিক। উন্নত যাত্রীসেবা নিশ্চিতে নেয়া হয়েছে আরো কিছু পদক্ষেপ। সরকারি এসব সহযোগিতা সত্ত্বেও এগোতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
বিমানবহরে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ যুক্ত করার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকার মতো বেশি দূরত্বে ফ্লাইট চালু করা। বর্তমানে বেশি দূরত্বের মধ্যে কেবল ঢাকা-লন্ডন রুটেই সীমাবদ্ধ বিমান। দীর্ঘ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনো চালু করা যায়নি ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটের ফ্লাইট। অল্প দূরত্বের রুটে ফ্লাইট কার্যক্রম সীমিত রাখাকে বিমানের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের ৩৭টি এয়ারলাইনস সরাসরি ও কানেক্টিং ফ্লাইটের মাধ্যমে ১০০টির বেশি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আর কাঙ্ক্ষিত যাত্রী মেলায় সব বিদেশী এয়ারলাইনসেরই লাভজনক রুটের তালিকায় রয়েছে ঢাকা। সেখানে রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইনস বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট রয়েছে মাত্র ১৫টি আন্তর্জাতিক রুটে। আর চালু থাকা এসব আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে অন্তত নয়টি লোকসানি। যদিও ৪২টি দেশের সঙ্গে বিমানের সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার চুক্তি রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রুট ম্যাপে দেখা যায়, বর্তমানে বিমানের আন্তর্জাতিক রুট কেবল মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ই সীমাবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যে কুয়েত, দাম্মাম, দোহা, রিয়াদ, জেদ্দা, আবুধাবি, দুবাই ও মাস্কাটে ফ্লাইট রয়েছে বিমানের। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট চালাচ্ছে বিমান। এছাড়া স্বল্প দূরত্বে কলকাতা, ইয়াঙ্গুন ও কাঠমান্ডুতে ফ্লাইট রয়েছে এয়ারলাইনসটির। ইউরোপে কেবল লন্ডন রুটেই ফ্লাইট রয়েছে বিমানের। দীর্ঘ ১০ বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর এপ্রিলে ফ্রাংকফুর্ট রুটে ফ্লাইট কার্যক্রম শুরু হলেও ঢাকা-রোম-ফ্রাংকফুর্ট রুটে ফ্লাইটপ্রতি গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে একপর্যায়ে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। একই কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বিমানের ঢাকা-হংকং ফ্লাইটও।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমানকে লাভজনক হিসেবে পরিচালনা করতে হবে। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে বিমানকেই। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তারা বলেছে, বিমানবহরে সব বড় বড় এয়ারক্রাফট থাকায় লম্বা রুটে চালালে যাত্রী সংকটের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এখন বিমানবহরে ছোট আকারের উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে তারা কীভাবে কোন রুটে পরিচালনা করলে লাভজনক হবে, তার পরিকল্পনা জানাতে বলা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির আগামী বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
সংসদীয় কমিটি বিভিন্ন বৈঠকে বিমানকে গতিশীল করতে বেশকিছু সুপারিশও করেছে। বিমানে ভবিষ্যতে যাতে টিকিট-সংক্রান্ত ও যাত্রীসেবার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অভিযোগ না আসে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে টিকেটিং ও লাগেজ হ্যান্ডলিংসহ আরো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে জরুরি ভিত্তিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, বিমানবালাদের দুই রঙের পোশাক পরিধানের নিমিত্তে একটি প্রস্তাবনা তৈরিসহ যাত্রীসেবার মান বাড়াতে কিছু সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানের লোকসানি রুটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো লাভজনক করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব রুটে যাত্রী কম হচ্ছে, সেগুলোয় কম আসনের উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি বহরে যুক্ত হওয়া বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ দিয়ে কম যাত্রীর রুট পরিচালনা করা হবে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা নিজ দেশ থেকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ৫০ শতাংশের বেশি যাত্রী দখলে রেখেছে। বিমান তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারের ক্রমাগত সহযোগিতায় নতুন বিনিয়োগ ও সক্ষমতা বাড়লেও বাজার দখলে এগোতে পারছে না এয়ারলাইনসটি।
লোকসানে থাকা বিমানকে মুনাফার ধারায় ফেরাতে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আনা হয় চারটি বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ। এগুলোর নামকরণ করা হয় যথাক্রমে পালকি, অরুণ আলো, আকাশ প্রদীপ ও রাঙা প্রভাত। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ হিসেবে দুটি ৭৭৭-২০০ ইআর, দুটি ৭৩৭-৮০০ ও দুটি ড্যাশ ৮কিউ৪০০ উড়োজাহাজ দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে বিমানবহরে সংযোজন হয়েছে। গত নভেম্বরে আনা হয়েছে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের নতুন আরো একটি উড়োজাহাজ; যার নামকরণ করা হয়েছে ‘মেঘদূত’। আর চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে বিমানবহরে যোগ হচ্ছে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ ‘ময়ূরপঙ্খী’।
এছাড়া আগামী বছর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি অথবা ৭৭৭-৩০০ ইআর মডেলের একটি উড়োজাহাজ লিজ নিতে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র (আরএফপি) আহ্বান করেছে বিমান। উড়োজাহাজগুলো আগামী পাঁচ বছরের (৬০ মাস) জন্য ড্রাই লিজে বিমানবহরে যুক্ত করা হবে।
প্রসঙ্গত, ‘আকাশে শান্তির নীড়’ স্লোগানে ১৯৭২ সালে যাত্রার পর টানা ১৮ বছর লোকসান দেয় বিমান। ৪৩ বছরের মধ্যে মাত্র সাত বছর মুনাফায় ছিল সংস্থাটি। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো মুনাফায় আসে বিমান। সে সময় টানা পাঁচ বছর মুনাফা করতে সমর্থ হয় সংস্থাটি। পরে আবারো লোকসানে পড়ে। অব্যাহত লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ বিমান করপোরেশনের নাম হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেড। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিমানের মোট লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
পাবলিক লিমিটেড করার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫ কোটি ১৯ লাখ ও ২০০৮-০৯-এ ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মুনাফা করে সংস্থাটি। তবে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে আবারো লোকসানে ফিরে যায় বিমান। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮০ কোটি, ২০১০-১১তে ১৯১ কোটি, ২০১১-১২তে ৬০০ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২১৪ কোটি টাকা লোকসান দেয় বিমান। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমানের লোকসান ছিল ২৬৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
Leave a Reply