গ্যাসের অর্ধেক মজুত শেষ

জেসমিন মলি | ২০১৬-০১-১৯ ইং

দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মজুত নিরূপণ করা হয় ২৭ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসই ব্যবহার হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে ১৩ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মেলেনি। যদিও মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত তা কাজে লাগানো যায়নি। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তাই পুরনো ক্ষেত্র থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদনেই দেশে গ্যাস মজুতের এ চিত্র উঠে এসেছে।

এখন পর্যন্ত যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে ২৪টিই স্থলভাগে। বাকি দুটি অফশোরে। বর্তমানে উৎপাদনে আছে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র, যার সবই স্থলভাগে।

দেশের সবচেয়ে পুরনো ও সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র তিতাস। ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত  ক্ষেত্রটিতে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত নিরূপণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৩৬৭ বিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট মজুত রয়েছে ২ হাজার ৩২০ বিলিয়ন ঘনফুট।

তিতাসের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্যাসের মজুত ছিল বিবিয়ানায় ৫ হাজার ৭৫৪ বিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে অবশিষ্ট আছে ৩ হাজার ৩৮০ বিলিয়ন ঘনফুট। মজুতের দিক দিয়ে এর পরই রয়েছে কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র। ক্ষেত্রটিতে মজুত রয়েছে ২ হাজার ৮৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস মজুত রয়েছে ১ হাজার ৮৭০ বিলিয়ন ঘনফুট। আর হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও ছাতকে ৪০০ বিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত রয়েছে। ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি মজুত রয়েছে শাহবাজপুর ও সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্রে। বাকি ক্ষেত্রগুলোয় অল্প পরিমাণে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিরও এক বছর পেরিয়ে গেছে। স্থলভাগেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য নেই। কয়েক বছর ধরে পুরনো ক্ষেত্রের পুনর্মূল্যায়নের মধ্যেই আটকে আছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। উৎপাদন বাড়াতে তাই জোর দেয়া হচ্ছে পুরনো গ্যাসক্ষেত্রে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে তা ২ হাজার ৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবে পাঁচ বছরে গ্যাস উৎপাদন দৈনিক প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূপ থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হলে ভূ-অভ্যন্তরে গ্যাসস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গ্যাস উত্তোলনের স্বাভাবিক প্রবাহ এতে নষ্ট হয়। ফলে কমে যায় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন মেয়াদ। নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। বাড়তি উৎপাদনের কারণে গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত হওয়ার উদাহরণ সমুদ্রবক্ষের একমাত্র উৎপাদনকারী ক্ষেত্র সাঙ্গু।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাস খাতে নেয়া সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়েছে। গত কয়েক বছরে নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। বাপেক্স কিছু চেষ্টা চালালেও তা সফল হয়নি। ফলে পুরনো ক্ষেত্র থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর উপরই জোর দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে ১৪ বছরের মজুত আছে। তবে চার-পাঁচ বছর পর চাপ কমতে শুরু করবে। ফলে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনও কমবে। তখন পুরনো ক্ষেত্র দিয়ে আর স্বাভাবিক সরবরাহ ধরে রাখা যাবে না। সমুদ্র ও স্থলভাগে দ্রুত নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে তাই এখনই জোর দিতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে একাধিক রিগ কেনা হয়েছে। যন্ত্রাংশের দিক দিয়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বাড়লেও কার্যক্রমে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বর্ধিত গ্যাসের বেশির ভাগই এসেছে পুরনো ক্ষেত্র থেকে।

জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান বলেন, আগামী পাঁচ বছরে নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই গ্যাস অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করা হবে।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে বাপেক্সের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বাপেক্স শক্তিশালী হলে আরো বেশি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারবে। একই সঙ্গে উৎপাদন কার্যক্রম মনিটরিং, মিয়ানমার-সংলগ্ন অফশোর ব্লকসহ সীমান্তবর্তী অনশোর ব্লকগুলোয় দ্রুততার সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২ হাজার ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক ২ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ হিসাবে গ্যাসের ঘাটতি থাকছে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

 

Leave a Reply