রাজধানীর ৬৫% এলাকা বহুতল ভবনের অনুপযোগী
জেসমিন মলি | ২০১৫-০৫-১৩ ইং
রাজধানী শহর ঢাকা। গত কয়েক দশকে এ নগরীর আয়তন যেমন বেড়েছে, তেমনি অপরিকল্পিতভাবে বেড়েছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। যদিও ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ মাটিই বহুতল ভবন নির্মাণের উপযুক্ত নয়। এছাড়া অধিকাংশ ভবনই মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা না করে নির্মিত হওয়ায় রাজধানীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বেশি।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর ৬৫ শতাংশ এলাকার মাটিই বহুতল ভবন নির্মাণে অনুপযুক্ত। কারণ নগরীর অধিকাংশ ঝিল, খাল, ডোবা ও নিচু এলাকা ভরাট করায় মাটির নিচে ‘পিট’ জমে আছে। এ পিট স্পঞ্জের মতো। শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। বৃষ্টির পানি পেলে ফুলে ওঠে। তখন এ রকম মাটির ওপর নির্মিত স্থাপনাও উপরের দিকে উঠে আসতে পারে। এসব এলাকায় মধুপুর ক্লে বা লাল মাটি অনুপস্থিত হওয়ায় বহুতল ভবণ নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ৩৫ শতাংশ এলাকার মাটি নিরেট লালসমৃদ্ধ হওয়ায় বহুতল ভবন নির্মাণে কোনো সমস্যা নেই।
তবে ঢাকার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা। এখানে লাল মাটিসমৃদ্ধ এলাকায় গড়ে উঠেছে তুলনামূলক কম উচ্চতার ভবন। অন্যদিকে অনুপযুক্ত নরম মাটির এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশি উচ্চতার ভবন। দুটোই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষকদের পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরান ঢাকার লাল মাটিতে ছয় থেকে আটতলা উচ্চতার যেসব অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। আর ঢাকার সম্প্রসারিত অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা বেশি উচ্চতার ভবনও ঝুঁকিতে আছে। লাল মাটিতে স্থাপিত কম উচ্চতার ভবন ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে ভেঙে পড়তে পারে এসব ভবন।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাল মাটিতে স্থাপিত এসব অবকাঠামো ধসে পড়ার অন্যতম কারণ অবকাঠামোর উচ্চতা। অন্যদিকে নরম মাটি ও ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে ভূমিকম্পের তীব্রতা বাড়ে। গবেষকরা তাই ঢাকার লাল মাটিতে স্থাপিত তুলনামূলক কম উচ্চতার অবকাঠামো এবং নরম মাটিতে গড়ে ওঠা বেশি উচ্চতার অবকাঠামোকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, শক্ত মাটিতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ দ্রুত চলে যায়। এ কারণে কম মাত্রার ভূমিকম্প শক্ত মাটিতে বেশি ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। শক্ত মাটিতে অবকাঠামোর উচ্চতা কম হলে ঝাঁকুনি মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। ফলে এসব অবকাঠামো ধসে পড়তে পারে।
এদিকে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের তৈরি ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রে রাজধানীর মাটির মানকে ১৫টি স্তরে তুলে ধরে প্রধানত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মানচিত্রে লাল, গোলাপি, সবুজ, হলুদ ও নীল রঙে চিহ্নিত করে মাটির মানকে বোঝানো হয়েছে। লাল রঙে চিহ্নিত এলাকার মাটি সর্বোচ্চ মানের। এ মাটি ১০০ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের উপযোগী। গোলাপি রঙের মাটি ছয়তলা উঁচু ভবন নির্মাণের উপযোগী। তবে পাইলিংয়ের মাধ্যমে ভিত দৃঢ় করে এ ধরনের মাটিতে আরো উঁচু ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে। এ মাটি স্বল্প উচ্চতার ভবন নির্মাণের জন্য মোটামুটি মানসম্পন্ন। অন্য তিনটি রঙ দিয়ে চিহ্নিত এলাকার মাটিতে কোনোভাবেই বহুতল ভবন নির্মাণ নিরাপদ নয়। নীল রঙ চিহ্নিত এলাকার মাটিতে কোনো অবকাঠামোই নির্মাণ করা যাবে না। সবুজ ও হলুদ রঙ দিয়ে চিহ্নিত এলাকায় বড়জোর ডুপ্লেক্স নির্মাণ করা যেতে পারে। ওই মানচিত্রে দেখানো হয়েছে, রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাকি এলাকার মাটির গুণগত মান বহুতল স্থাপনার জন্য উপযুক্ত নয়। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ মানের মাটি রয়েছে কোতোয়ালি, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, কমলাপুর, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরখান, উত্তরার অংশবিশেষ এবং মিরপুর ১, ২, ৩, ৬ ও ১০ নম্বর এলাকা। অন্যদিকে নিম্নমানের মাটি রয়েছে মেরাদিয়া, সাঁতারকুল, বাড্ডার অংশবিশেষ, মিরপুর ১৪ নম্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেনের আশপাশের নিম্নাঞ্চল, কল্যাণপুর ও মোহাম্মদপুরের অংশবিশেষ, পল্লবীর নিম্নাঞ্চল, কালাপানিসহ আরো কয়েকটি এলাকা। এসব এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করাই উচিত নয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীতে নিম্নমানের মাটি রয়েছে এমন এলাকায় সুউচ্চ ভবন গড়ে উঠেছে সবচেয়ে বেশি। আর লাল মাটিসমৃদ্ধ এলাকায় বেশি উচ্চতার ভবনের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, মাটির গঠনের ওপর নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের কম্পনের তীব্রতা। স্বাধীনতার আগে ঢাকার অবস্থান লাল মাটিতে থাকলেও পরবর্তীতে সম্প্রসারণের ফলে পলল ভূমিতে রাজধানীর আয়তন বেড়েছে। অবকাঠামোর নকশা করার আগে ল্যান্ডস্কেপ অনুযায়ী স্থাপত্য নকশা করা উচিত এবং সে অনুযায়ী অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রীর ওপরও অবকাঠামোর স্থায়িত্ব নির্ভর করে। এজন্য অবকাঠামো তৈরিতে তদারকি বাড়ানো উচিত। এ কাজ শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। একে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে পারলে ভূমিকম্প এবং এ-জাতীয় দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।
এদিকে বিশ্বব্যাংক ও আর্থকোয়েকস অ্যান্ড মেগাসিটিস ইনেশিয়েটিভ (ইএমআই) যৌথভাবে প্রণীত ‘ঢাকা প্রোফাইল অ্যান্ড আর্থকোয়েক রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, মধুপুরে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ২৭ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর বেশির ভাগই উত্তর সিটি করপোরেশন তথা নতুন ঢাকার অন্তর্ভুক্ত। এতে দুই লাখ মানুষ আহত ও ৫০ হাজার নিহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫৭৩ কোটি ডলার বা ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি ওয়ার্ডের সবই নতুন ঢাকায়। তবে মাটির গঠন অনুযায়ী ভবন নির্মাণ না করায় পুরান ঢাকা মাঝারি মানের ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সম্প্রতি নেপালে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে। শক্ত মাটি হলেও প্রচুর ভবন ধসে পড়ে, যার বেশির ভাগই অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার। মূলত কম উচ্চতার ভবনে ভূকম্পন ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন স্থপতি ও ভূতাত্ত্বিক গবেষকরা।
Leave a Reply