না দেয়ার সুপারিশ সত্ত্বেও ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ

জেসমিন মলি | ২০১৫-১১-০৮ ইং

www.bonikbarta.comবেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক টেকনো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির নামে ৮৪ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরের বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি। তা আমলে না নিয়ে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত ৩১৪তম বোর্ডসভায় ঋণটি অনুমোদন করা হয়।

গুলশান শাখারই আরেক গ্রাহক এসকিউ হিউজ লিমিটেডের ১৪২ কোটি টাকা ঋণের বিষয়েও নেতিবাচক সুপারিশ ছিল ঋণ কমিটির। যদিও এ প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রস্তাবও অনুমোদন করে বেসিক ব্যাংকের তত্কালীন পর্ষদ।

একইভাবে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকিং লিমিটেডের নামে অনুমোদন করা হয় ১৭৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটির নেতিবাচক সুপারিশ সত্ত্বেও ১৮৭ গ্রাহকের নামে অনুমোদন করা হয় ৫ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকার ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন, বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদফতর, দুটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসিক ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে অনিয়মের এ চিত্র উঠে এসেছে। গত ২৭ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপন করা হয় প্রতিবেদনটি। এ অনিয়মের জন্য প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে ব্যাংকটির তত্কালীন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে।

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরিচালিত পরিদর্শনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে প্রকৃত অনিয়মের পরিমাণ আরো বেশি। আমরা এসব গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। এসব ঋণ নিয়মের মধ্যে এনে আদায়ের চেষ্টা চলছে।

নেতিবাচক সুপারিশ সত্ত্বেও যেসব ঋণ অনুমোদন হয়েছে, তার মধ্যে ৬২টি প্রস্তাব রয়েছে গুলশান শাখার। এছাড়া শান্তিনগর শাখার প্রস্তাব রয়েছে ৫৯টি, দিলকুশা শাখার ১৯টি, কারওয়ান বাজার শাখার ১৬টি, প্রধান কার্যালয়ের ১৬টি, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখার চারটি, জুবিলী রোড শাখার দুটি, বসুন্ধরা শাখার একটি ও সৈয়দপুর শাখার চারটি। সব প্রস্তাবের ব্যাপারেই নেতিবাচক সুপারিশ ছিল ঋণ কমিটির।

এ পন্থায় অনুমোদিত ১০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ রয়েছে আটটি। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার গ্রাহক নিউ অটো ডিফাইনের নামে অনুমোদন করা হয় ১৭৮ কোটি ও আরআই এন্টারপ্রাইজের ১২০ কোটি টাকার ঋণ।

সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ অনুমোদন ও বিতরণে ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এছাড়া শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে রয়েছে ঋণ কমিটি; যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পর্ষদ তা মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঋণ মঞ্জুরের বিষয়ে কমিটি নেতিবাচক মতামত দেয়ার পরও তত্কালীন পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণগুলো অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ক্ষেত্রবিশেষে আবেদনের এক-দুদিনের মধ্যেই অনুমোদন করা হয়েছে। এমনকি গ্রাহকের হিসাব খোলার আগেই তা অনুমোদিত হিসেবে পর্ষদের কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনটা ঘটেছে মেসার্স অটো ডিফাইনের ক্ষেত্রে। প্রতিষ্ঠানটির নামে হিসাব খোলা হয় ২০১০ সালের ৩ নভেম্বর। অথচ তাদের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হয় হিসাব খোলার একদিন আগে ২ নভেম্বর। এছাড়া দিয়াজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। ২০১২ সালের ২৭ মার্চ গুলশান শাখায় হিসাব খোলে প্রতিষ্ঠানটি। পরদিন অর্থাৎ ২৮ মার্চ পর্ষদ কর্তৃক ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বেসিক ব্যাংকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও তত্কালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি। এ অনিয়মের জন্য ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদ কতটা দায়ী, তা তদন্ত করে প্রচলিত আইন ও বেসিক ব্যাংকের নিজস্ব আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো খেলাপি গ্রহীতার অনুকূলে ঋণ অনুমোদনের বিধান নেই। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির মতামত ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের স্মারকলিপিতে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার পরও পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের তিনটি ঋণ-প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। শান্তিনগর, গুলশান ও দিলকুশা শাখায় তিন গ্রাহকের শ্রেণীকৃত সিআইবি উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৯৬ কোটি টাকার ঋণ-প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে শান্তিনগর শাখা থেকে মেসার্স হাবিব এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়েছে ৩৬ কোটি টাকার ঋণ। একই শাখার গ্রাহক ওয়েস্টকোস্ট শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডকে দেয়া হয়েছে ৪০ কোটি ও দিলকুশা শাখা থেকে সিমেক্স লিমিটেডের নামে অনুমোদন হয়েছে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ।

উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধানের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাইরে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে অভিযুক্ত করা হলেও আসামির তালিকায় নাম নেই ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর।

 

Leave a Reply