গৃহঋণের ৮০: ২০ নীতিতে ডুবেছে আবাসন খাত

জেসমিন মলি | ২০১৫-১০-২৮ ইং

www.bonikbarta.com২০১০ সালের আগ পর্যন্তও গৃহায়ণ খাতে ঋণ মার্জিনের অনুপাত ছিল ৮০: ২০। অর্থাত্ ফ্ল্যাট কিনতে গ্রাহক ২০ শতাংশ অর্থায়ন করলে ব্যাংকঋণ মিলত ৮০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০০৪ সালের ভোক্তাঋণ নীতিমালার আওতায় এ নির্দেশনা জারি হয়। এতে সহজলভ্য হয়ে পড়ে গৃহঋণ; যা অতিমূল্যায়িত করে তোলে খাতটিকে। যদিও মূল্য কমিয়েও এখন আর ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না আবাসন ব্যবসায়ীরা।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ১ হাজার ৬৯২ টাকা। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০০০ সালে প্রতি বর্গফুটের দাম মাত্র ৩৬৭ টাকা বেড়ে হয় ২ হাজার ৫৯ টাকা। ২০০৫ সাল পর্যন্তও মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল অনেকটা সহনীয়। এ সময় প্রতি বর্গফুট বিক্রি হয় গড়ে ৩ হাজার ৬৪ টাকায়। তবে ২০১০ সালে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম বিশ্বের অনেক শহরকেই হার মানায়। প্রতি বর্গফুট বিক্রি হয় গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকায়।

আবাসনে ব্যক্তিপর্যায়ে ৮০: ২০ ঋণ মার্জিন অনুপাত এ সময় অর্থাত্ ২০১০ সাল পর্যন্ত বলবত্ ছিল। যদিও খাতটির অতিমূল্যায়নের কারণে পরবর্তীতে ঋণ মার্জিন অনুপাতে পরিবর্তন আনা হয়। নীতিমালা সংশোধন করে ২০১০ সালে ঋণ মার্জিন অনুপাত ৫০: ৫০-এ নামিয়ে আনা হয়। ২০১২ সালে আবার এ অনুপাত বাড়িয়ে ৭০: ৩০ করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, আবাসন খাতের উত্থানে তারল্যের বড় একটি ভূমিকা ছিল। পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী নীতিনির্ধারণ করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। পরবর্তীতে এ খাতে ঋণ প্রদানে সতর্কতামূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে খাতটির অবস্থা এখনো নাজুক।

বাংলাদেশের আবাসন খাতের অতিমূল্যায়নের তথ্য উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড রিভিউ অব বিজনেস রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত ‘ইজি ক্রেডিট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট বাবল ইন ঢাকা, বাংলাদেশ: দ্য নেক্সাস অ্যান্ড পলিসি ইমপ্লিকেশনস ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে। গৃহনির্মাণ খাতে বড় অঙ্কের ঋণের কারণেই খাতটি অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে এ খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা; যা তিন বছর আগে ছিল মাত্র ৩ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। এছাড়া তিন বছরে বেসরকারি ব্যাংক এ খাতে ঋণ দেয়ার হার প্রায় ১১৩ শতাংশ বাড়ায়। এতে ২০০৯ সালে গৃহঋণ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ২০০০-১০ পর্যন্ত এক দশকে অ্যাপার্টমেন্টের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটে। বিশেষ করে ২০০৬ সালের পর থেকে এ খাত অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। সে সময় রাজধানীর অভিজাত অনেক এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতি বর্গফুটে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা; যা অন্যতম ব্যয়বহুল শহর মুম্বাইয়ের অ্যাপার্টমেন্টের দামের কাছাকাছি।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক এম. সেরাজ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, অন্য সবকিছুর মতো অ্যাপার্টমেন্টের দামও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মূল্যবৃদ্ধি তারই ধারাবাহিকতা। দেশের অর্থনীতি তথা বাজারে অর্থের প্রবাহ ভালো থাকলে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ভালো থাকে। যেহেতু অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় ব্যয়বহুল, তাই ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থের সরবরাহ ভালো না থাকলে কেউ তা ক্রয়ে আগ্রহী হন না। ১৯৯০ সালের অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যের সঙ্গে ২০১০ সালের মূল্য তুলনা করলে আসলে দেশের মূল্যস্ফীতির চিত্র উপস্থাপিত হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পণ্যের ২০ বছরের মূল্যবৃদ্ধি তুলনা করলে একই চিত্র পাওয়া যাবে।

এদিকে আবাসন খাতের চাহিদা বিবেচনায় ২০০৭ সালে ৩০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৯ সালে তা ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এ তহবিলের আওতায় একজন গ্রাহক ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ পান। পরে অবশ্য বিনিয়োগস্ফীতি লক্ষ্য করে ২০১০ সালের এপ্রিলে সার্কুলার জারি করে সম্পত্তিতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব শহর খুব দ্রুতবর্ধনশীল, সেখানে আবাসনের দাম বাড়তে থাকে। কৃত্রিমভাবেও দাম বাড়ানো হয়। তখন অনেক ব্যবসায়ী এ খাতে আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ বাড়ান। ২০০৯ সালের পর দেশে আবাসন খাতের চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন ডেভেলপার এ খাতে ব্যবসা শুরু করেন।

রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, ১০ বছর আগে সংগঠনটির সদস্য ছিল ১৫০। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০টিতে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক ফ্ল্যাটই এখন অবিক্রীত পড়ে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৬ সালে আবাসন খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছিল ১০ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে এসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

আবাসন খাতের এ অতিমূল্যায়ন ব্যাংকিং খাতের ভুল নীতির জন্য নয় বলে দাবি করেন মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন। তিনি বলেন, সে সময় শেয়ারবাজারে চাঙ্গাভাব থাকার কারণে সবার হাতে নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল। অ্যাপার্টমেন্ট খাতেও চাহিদা বেড়ে যায়। ব্যাংকও এ খাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়ায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে সে সময় এ খাতে এক ধরনের উত্থান হয়েছিল। সব খাতেরই ভালো-খারাপ সময় আসে। সে রকম এ খাতেও খারাপ সময় এসেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের কোনো ভুল নীতি ছিল বলে মনে হয় না।

উল্লেখ্য, ২০০৭-০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার শুরুটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের বাবল (বুদ্বুদ) থেকে। গ্রাহকদের ঋণগ্রহণ বাড়াতে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যাংকঋণ নিয়ে আবাসন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। গ্রাহকদের অতিরিক্ত চাহিদা বিবেচনা করে কিছু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও এসব ঋণ ডিসকাউন্টে কিনে নিয়ে মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে ডিবেঞ্চার ও শেয়ারবাজারে ছেড়ে দিতে থাকে। এভাবে ব্যাংকের হাতে নতুন ঋণ দেয়ার জন্য তহবিলের সংস্থান হয়ে যায়। গ্রাহকের সক্ষমতা বিবেচনা না করেই ব্যাংক আবাসন খাতে ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখে; যার প্রভাবও পড়ে খুব দ্রুত। গ্রাহকের সক্ষমতা বিবেচনা না করে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ফলে অনেক গ্রাহকই প্রথম কিস্তি থেকেই খেলাপি হয়ে পড়েন। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক বন্ধকিকৃত সম্পত্তি বিক্রির উদ্যোগ নিলে আবাসন খাতে দরপতন ঘটতে থাকে; যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে।

 

Leave a Reply