অপেশাদারিত্ব অদক্ষতায় টেলিটকের দৈন্যদশা
জেসমিন মলি ও সুমন আফসার | ২০১৫-১০-১৩ ইং
গ্রাহক সংখ্যার হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেলফোন অপারেটর চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না মোবাইল। এ তালিকায় এগিয়ে থাকা সেলফোন অপারেটরদের অনেকগুলোই রাষ্ট্রায়ত্ত। অথচ দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের একমাত্র সেলফোন অপারেটর টেলিটক বাজার দখলের লড়াইয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না পাওয়ার পাশাপাশি সেবাদানের মানসিকতা সম্পন্ন পেশাদার, দক্ষ ও উপযুক্ত কর্মী বাহিনীর অভাবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
মানসম্পন্ন সেলফোন সেবা দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রায় এক দশক আগে যাত্রা করে টেলিটক। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রাহকদের বিস্তর অভিযোগ-অনুযোগ। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িকভাবে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রেও পেছনের সারিতেই এর অবস্থান। আর এক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স, ইলেকট্রনিকস ও কমিউনিকেশন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় টেলিটকের সুযোগ ছিল দেশের অন্যতম শীর্ষ অপারেটর হিসেবে কাজ করার। সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি তারা। সেবা দেয়ার ইতিবাচক মনোভাব না থাকার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে। অন্য অপারেটররা পারলে তারা কেন পারছে না, বিষয়টি তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। গ্রাহক আস্থা অর্জনের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নজরদারি বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাজে গতিশীলতা আনতে হবে।
টেলিটকের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। তবে সম্প্রতি গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় অনেক গ্রাহক। কেন্দ্রগুলোয় কর্মরতদের মধ্যে সেবাদানের মানসিকতার অভাব অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছেন গ্রাহকরা। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের কর্মীদের ঔদাসীন্যের কারণে গ্রাহকসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহককে অপেক্ষমাণ রেখে তারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা মোবাইল ইন্টারনেট সেটিংস ঠিকভাবে কনফিগার করতে পারেন না। আধুনিক সেলফোন সেবা ও হ্যান্ডসেটের বিষয়েও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে গ্রাহকসেবা কেন্দ্রের কর্মীদের। জরুরি হটলাইন পরিষেবা আগের তুলনায় সক্রিয় হলেও সরকারি ছুটির দিনগুলোয় জরুরি হটলাইনে কল করে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা পাওয়া যায় না। এছাড়া সেবা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সব তথ্য পান না বলেও গ্রাহকদের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, টেলিটকের গ্রাহক সেবা আরো উন্নত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি ডাক বিভাগের একটি কক্ষ ব্যবহার করতে পারে কিনা, তা বিবেচনায় রয়েছে। তিনি জানান, বেসরকারি অপারেটরদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে যে গতি প্রয়োজন ছিল, তা সম্ভব হয়নি। স্বদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিটকের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করছি। অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটা ও বিভিন্ন সেবা নিতে টেলিটকের পরিধি বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত এ সেলফোন অপারেটরের ওয়েবসাইটটিতেও রয়েছে অপেশাদারিত্বের ছাপ। অন্য সেলফোন অপারেটরগুলোর তুলনায় টেলিটকের ওয়েবসাইট ব্যবহারবান্ধব নয়। নির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পেতে গ্রাহক ও তথ্যানুসন্ধানীদের যথেষ্টই বেগ পেতে হয়।
টাওয়ার অপ্রতুলতার কারণে দেশের অনেক স্থানেই টেলিটকের নেটওয়ার্ক পেতে সমস্যা হয়। সেই সঙ্গে দেশের অনেক স্থানেই টেলিটকের রিচার্জ পাওয়া না। অন্য অপারেটরদের বিক্রয় প্রতিনিধিদের তুলনায় টেলিটকের বিক্রয় প্রতিনিধিরা কম গ্রাহকের অজুহাতে অনেক কম সক্রিয়। এর কারণে গ্রাহক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সংযোগ কম পরিমাণে বিক্রি হয়। নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক ট্যারিফ নিশ্চিত করা হয় না।
টেলিযোগাযোগ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় তুলনামূলক আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদিক দিয়ে অনেকখানিই পিছিয়ে টেলিটক। ফলে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এ খাত সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থী পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগ পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে টেলিটককে ব্যবহার করছেন কর্মীরা।
সবমিলিয়ে টেলিটকে প্রায় ৭০০ কর্মী রয়েছেন। তবে এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই এসেছেন আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) থেকে। প্রেষণে আসা এসব কর্মকর্তাদের টেলিটক নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো লক্ষ্য নেই। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে টেলিটক।
সম্প্রতি বেতন-ভাতা ও পদোন্নতি নিয়ে অসামঞ্জস্য ও অসন্তোষের বিষয়টি লিখিতভাবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে টেলিটক এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (টিইডব্লিউএ)। সংগঠনটির দেয়া চিঠিতে বলা হয়, টেলিটকে ব্যবস্থাপক, উপমহাব্যবস্থাপকের মতো বেশকিছু পদে পদোন্নতির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি, যা তাদের জন্য হতাশাজনক। প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামোতে রাখা হয়েছে অপরিকল্পিত ও অবিবেচনাপ্রসূত পদ। ফলে পদোন্নতি ও বেতন কাঠামোয় তৈরি হয়েছে অসামঞ্জস্য ও অসঙ্গতি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি।
বেতন-ভাতার বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বেতন-ভাতা তাদের পারফম্যান্স দিয়ে আদায় করে নিতে হবে। টেলিটকে যে পরিমাণ গতিশীলতা আসার দরকার ছিল, তা হয়নি। বাজার প্রতিযোগিতায় বেতন-ভাতা দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু কাজ করে প্রমাণ করতে হবে, তারা তার যোগ্য। টেলিটককে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে বা কাছাকাছি যেতে হবে।’
Leave a Reply