অনিয়ম-দুর্নীতি পিছু ছাড়ছে না টেলিটকের

জেসমিন মলি ও সুমন আফসার | ২০১৫-১০-১২ ইং

www.bonikbarta.comটেলিটকের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগ বেসরকারি খাতের তিন সেলফোন অপারেটরের। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযানও চলে। এতে গত কয়েক মাসে ব্লক করা হয় টেলিটকের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার সিম। আপত্তি রয়েছে টেলিটকের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও। আর এ অডিট আপত্তি তুলেছে সরকারের নিরীক্ষা অধিদফতর।

এভাবেই দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও টেলিটক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে সেলফোন সেবা প্রদানের পাশাপাশি সরকারি আয়ের নতুন উৎস তৈরি করা।

টেলিটকের অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করে বেসরকারি তিন সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি। অভিযোগে তারা জানায়, টেলিটক সিমের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপির কারণে গত মে ও জুনে অন্যান্য অপারেটর রাজস্ব হারিয়েছে। অভিযোগের সমর্থনে তারা টেলিটকের কল তালিকা কমিশনের কাছে পাঠায়। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টেলিটককে কারণ দর্শানোর জন্য তিন দফা চিঠি দেয় বিটিআরসি। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো চিঠিরই জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে গত বছরের জুলাইয়েও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও মন্ত্রণালয়কে একই অভিযোগে চিঠি দেয় এ তিন অপারেটর।

টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সব অপারেটরের সিমেই ভিওআইপি হয়ে থাকে। টেলিটকের বিরুদ্ধে অনেক সময় অযাচিত অভিযোগ করা হয়, যা ঠিক নয়। ভিওআইপির অভিযোগে আমরা নিয়মিত তদারকি চালিয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

নিরীক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, টেলিটকের শুরু থেকে ২০১০-১১ অর্থবছর পর্যন্ত সাত বছরের কার্যক্রম নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিয়েছে অধিদফতর। প্রতিবেদনে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার নিরীক্ষা আপত্তি তোলা হয়। এর মধ্যে ছিল প্রি-পেইড সিমকে পোস্টপেইডে রূপান্তর করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া, বাজারদরের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে সিমকার্ড কেনা, ভিওআইপির অবৈধ কার্যক্রমে ফ্রি আইএসডি কল করতে দেয়াসহ কোম্পানির ক্ষতিসাধনের কয়েক ডজন কারণ উল্লেখ করা হয়। এর বাইরে বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানটির কমপ্লায়েন্স নিয়ে করা প্রতিবেদনেও বড় ধরনের অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে টেলিটকের ভাণ্ডারে বিপুল অর্থের সিমকার্ড ও স্ক্র্যাচকার্ডের কোনো হদিস নেই। টেলিটকের লেজার ও অন্যান্য হিসাবে মজুদ ৩১ কোটি টাকার বিভিন্ন মূল্যমানের স্ক্র্যাচকার্ড ও ক্যাশকার্ড ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে ৪৩ হাজার ২৭১টি সিমকার্ডের মজুদ ঘাটতির ফলে কোম্পানি ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ আরো ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯ টাকা।

এ নিয়ে টেলিটকের এমডির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। অডিট আপত্তির অনেক বিষয় নিয়ে সময় সময় টেলিটক থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। বেশকিছু আপত্তির জবাবও দেয়া হয়েছে।

অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিটকের বিপণন শাখা কেন্দ্রীয়ভাবে স্ক্র্যাচকার্ড ও ক্যাশকার্ড ক্রয়-বিক্রয়, বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে ইস্যু ও মজুদ হিসাব সংরক্ষণ করে। সে অনুযায়ী বছর শেষে কেন্দ্রীয় মজুদ হিসাবে বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে ইস্যুসহ মোট মজুদ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রত্যয়নসহকারে মজুদ হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মজুদ হিসাবে একটি ধাপে ২১ কোটি ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০ টাকা মূল্যমানের স্ক্র্যাচকার্ড ও ক্যাশকার্ড ঘাটতি রয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালের আরেকটি হিসাবে দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার গরমিল। সেখানে বলা হয়েছে, ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর যাচাইকরণের সময় প্রতিটি ৩০০ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ২৯২টি স্ক্র্যাচকার্ড কম পাওয়া যায়। তখন ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৬০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করা হলেও এখন পর্যন্ত দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এদিকে দরপত্র ছাড়াই সিম কেনার অভিযোগ রয়েছে টেলিটকের বিরুদ্ধে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রায় সোয়া চার লাখ সিম কেনা হয় এ প্রক্রিয়ায়। দুটি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা প্রতিটি সিমের বাজারদর ৬১ টাকা হলেও কেনা হয় ১৭৮ টাকা ২১ পয়সা দরে। এখানে টেলিটকের ৩ কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।

শুরুর দিকে টেলিটকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য ৭৪৫টি হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয়। ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আর্থিক হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি হ্যান্ডসেটের দাম ২৮ হাজার টাকা। হ্যান্ডসেটগুলোর ৬২০টি বিতরণ করা হলেও বাকি ১২৫টি হ্যান্ডসেটের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

ডিলারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিল জেনারেটের মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০ প্রি-পেইড সিমকে পোস্টপেইডে রূপান্তরের অভিযোগ উঠেছে টেলিটকের দুই কর্মকর্তা এসএম তারেক ও হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। গ্রাহকপ্রতি ৩০০ টাকা করে নিয়ে এ সুবিধা দেন ওই দুই কর্মকর্তা। এতে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের মে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয় ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার ২৮৪ টাকা। পরবর্তীতে এসএম তারেকের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১১ লাখ ও হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমানে বিষয়টি দুদকের তদন্তাধীন।

গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়মিত ভ্যাট আদায় করলেও দুই অর্থবছরে ১৭৪ কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে জমা করেনি টেলিটক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরের বাকি থাকা ১৬২ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৪ টাকার কিছুটা জমা করা হলেও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে আদায় করা ১২ কোটি ১২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৪৭ টাকা তারা জমা করেনি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, টেলিটকে দুর্নীতি-অনিয়মে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কেউ যদি মনে করেন, দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারবেন না, তাদের মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা যেন চাকরি ছেড়ে চলে যান। এক ধরনের শুদ্ধি অভিযানের মতো চলছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গতিশীলতা আনতে কাজ করছি।

Leave a Reply