২০১৮ সালের আগে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না অর্থনৈতিক অঞ্চল
জেসমিন মলি | ২০১৫-০৯-০৬ ইং
শিল্প উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের বেশ কয়েকটির কাজও শুরু হয়ে গেছে। যদিও এখনো সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি সরকার। কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হলেও ২০১৮ সালের আগে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সম্ভাবনা নেই।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। তবে এসব অবকাঠামোর কোনোটিরই উন্নয়নকাজ ২০১৭ সালের আগে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ করতে কাগজে-কলমে ২০১৭ সালের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন হতে আরো বেশি সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে আলাদা বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করে হলেও এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক লোডের প্রাথমিক চাহিদা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। তাদের হিসাবে, মৌলভীবাজারে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ সালে বিদ্যুতের লোডের চাহিদা হবে পাঁচ মেগাওয়াট। ২০১৭ সালে এ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫ মেগাওয়াটে।
গাজীপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থিত শ্রীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ সালে বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে পাঁচ মেগাওয়াট; যা পরবর্তী দুই বছরে ৬০ ও ১০০ মেগাওয়াটে পৌঁছবে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা (২) অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ সালে পাঁচ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও তা পরবর্তী দুই বছরে বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৮৫ ও ১৫৫ মেগাওয়াটে। মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ সালে পাঁচ মেগাওয়াট চাহিদা নিরূপণ করা হলেও পর্যায়ক্রমে পরবর্তী দুই বছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ ও ৪০ মেগাওয়াটে। কুমিল্লার আব্দুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ২০১৬ সালে ১৫ মেগাওয়াট এবং পরবর্তী দুই বছরে ৩০ ও ৫০ মেগাওয়াট নির্ধারণ করা হয়েছে। নরসিংদীর এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ থেকে পরবর্তী তিন বছরের জন্য চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে যথাক্রমে ১০, ২০ ও ৪০ মেগাওয়াট।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৭ সালে দুই মেগাওয়াট চাহিদা নিরূপণ করা হলেও ২০১৮ সালে তা ১০ মেগাওয়াটে পৌঁছবে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০১৬ সাল ও পরবর্তী দুই বছরের জন্য চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০, ৪০ ও ৫০ মেগাওয়াট। ওই তিন বছরে কুমিল্লার বিজিএমইএ গার্মেন্ট শিল্প পার্কে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০, ১৫ ও ২০ মেগাওয়াট।
এদিকে মংলায় দেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ২০৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে ৪৭ কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ অনুমোদন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাগেরহাটে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ২০৫ একর অব্যবহূত ভূমি অধিগ্রহণের পর তা উন্নয়নে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে মংলা গ্রিড থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে বাড়তি চাহিদার লোড সরবরাহের জন্য মংলা গ্রিডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে বলা হয়েছে।
এর আগে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আকর্ষণে সীমাবদ্ধতার বেশ কয়েকটি কারণের একটি বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা বলে উল্লেখ করে।
মংলার পর মৌলভীবাজারের শেরপুরে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য ৩৫৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জমি উন্নয়নে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে শেরপুর ছাড়াও চট্টগ্রামের মিরসরাই ও আনোয়ারায় তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ২০১৩ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে জাপান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (জেডিআই), যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাক্সওয়েল স্টাম্প লিমিটেড ও বাংলাদেশের শেলটেক কনসালট্যান্ট।
সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়, শেরপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাছাকাছি রয়েছে বিমানবন্দর ও রেলস্টেশন। সড়কপথেও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলটি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে কুশিয়ারা নদী। এক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিবিয়ানা বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা নেয়া হলেও কতটুকু চাহিদা মেটানো যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ শেরপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে টেক্সটাইল, সিরামিক, ওষুধ, রঙ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রভৃতি শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। এসব শিল্পে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ জরুরি।
যোগযোগ করা হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মহাব্যবস্থাপক অতিরিক্ত সচিব হরিপ্রসাদ পাল বলেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারিগুলোর নির্মাণকাজ আগে শেষ হবে। সরকারি বা বেসরকারি যেটাই হোক, নির্মাণকাজের শুরুতেই বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন পড়বে। বিদ্যুৎসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস সময়মতো নিশ্চিত করাই সরকারের প্রতিশ্রুতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগ থাকলেও অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ আর্কষণে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বেশ দুর্বল। এক্ষেত্রে বেশকিছু কারণের কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পুরো কার্যক্রমটি এগোচ্ছে বেশ ধীরগতিতে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বেশির ভাগ অঞ্চল গড়ে ওঠার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ উদ্যোগ শুধু সরকারি পর্যায়েই রয়েছে।
বেজা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সরকারি মালিকানায়ই স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। বেসরকারিগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে স্থানীয়, প্রবাসী বাংলাদেশী বা বিদেশী ব্যক্তি, সংস্থা ও ব্যবসায়ী দলকে দিয়ে। পিপিপিগুলো হবে দেশী বা বিদেশী ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এছাড়া বেসরকারি, পিপিপি বা সরকারি উদ্যোগে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল সফল করতে দেশী ও বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগকারীদের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সার্বিক অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছি ঠিক, তবে অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের সফলতা বা ব্যর্থতা থেকে এখনো অনেক দূরে।
Leave a Reply