দেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানে আস্থা কমছে

জেসমিন মলি | ২০১৫-০৮-২৩ ইং

www.bonikbarta.com২০১১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে দেশীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ফজল অ্যান্ড কোম্পানি। এ নিরীক্ষার ভিত্তিতে ওই বছরের ৩ অক্টোবর গ্রামীণফোনের কাছে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেয় টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তবে ফজল অ্যান্ড কোম্পানির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে গ্রামীণফোন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি, যদিও এতে আপত্তি জানায় ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।

মূলত দেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিদেশীদের আস্থা কমতে থাকায় নিরীক্ষা কাজে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দাবি উঠছে। একই কারণে কয়েক বছর আগে থেকেই দেশী কিছু বড় প্রতিষ্ঠানও বিদেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে বিদেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকেও (বিপিসি) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশী প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এতে রাজি না হওয়ায় বর্ধিত ঋণ সহায়তার শেষ দুই কিস্তির ২৮০ মিলিয়ন ডলার আটকে দেয় দাতা সংস্থাটি। পরে বিদেশী নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করানোর শর্ত মেনে নিয়ে অর্থ নিতে রাজি হয় বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সংকটের কারণেই দেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানে আস্থা কমছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ অনেক নিরীক্ষক সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন না। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানি যেভাবে চায় নিরীক্ষক সেভাবেই আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেন। আবার অনেক কোম্পানি নির্দিষ্ট বছরের একাধিক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। একটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য, ব্যাংকঋণ নেয়ার জন্য আরেকটা।

অভিযোগ আছে, আর্থিক নিরীক্ষা পেশাদারদের সংগঠন আইসিএবি এ খাতের পেশাজীবীদের সংগঠন হিসেবে তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। সংগঠনটির সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা কার্যক্রমে আস্থা রাখতে পারছে না দেশীয় স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও। এরই মধ্যে বেশকিছু বড় শিল্প গ্রুপ নিজেদের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া শুরু করেছে।

তবে এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন আইসিএবি প্রেসিডেন্ট মাসিহ্ মালিক চৌধুরী। তিনি বলেন, অডিটরদের জন্য নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ীই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অডিট পরিচালনা করা হয়। অডিট প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ আমরা শেষ হয়ে যাওয়া বছরের অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করি। আর যেসব প্রতিষ্ঠান মানসম্মত অডিট প্রতিবেদন তৈরি করে না, তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। কমিটি অত্যন্ত কঠোরভাবে অডিটরের মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিরীক্ষা কাজের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করলেও মানসম্পন্ন প্রতিবেদন তৈরি করে না। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান শিক্ষানবিশদের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে হিসাবের গরমিল থাকে। সরকারসহ বিদেশীদের কাছে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। পাশাপাশি কম পরিশ্রমে এবং কম সময়ে অধিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বাড়ানোর প্রবণতা রয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। ফলে তাড়াহুড়া করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করায় মান খারাপ হচ্ছে।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অপেশাদারি কার্যক্রমের জন্য তাদের ওপর আইসিএবির নিয়ন্ত্রণহীনতাকে দায়ী করেছে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। মূলত এসব কারণেই দেশীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অষ্টম বৈঠকে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, আমাদের দেশের নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন রকম আপত্তি তোলে। তারা বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য সুপারিশও করে।

তিনি বলেন, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট পাস হলে আমাদের পক্ষে যুক্তি দেখানো সম্ভব হবে যে, আমাদের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, একটা নিয়মের মধ্যে আনা হয়েছে। কাজেই এখানকার অডিটের মান অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হবে এবং এখানে কোনো আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের কাজ করার প্রয়োজন হবে না।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ ও ডেসটিনিসহ বড় বড় দুর্নীতির নেপথ্যে রয়েছে দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদন। দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদনের কারণেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। প্রাতিষ্ঠানিক সঠিক কোনো আর্থিক রিপোর্ট না থাকার কারণে দুর্নীতির পাশাপাশি দাতাদের কাছ থেকে অর্থ ও বিনিয়োগ আনা এবং ঋণ করার ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়ে পড়ছে। এজন্য সরকারের গত মেয়াদের শেষ ভাগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) চাপে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এছাড়া এডিবি শেয়ারবাজার শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্বের অর্থায়নে যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে এফআরএর বিষয়ও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট পাস ও বাস্তবায়ন হলে কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। পাশাপাশি নিরীক্ষা সেবাদাতাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনও আরো বিশ্বাসযোগ্য হবে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে।

জানা গেছে, প্রস্তাবিত আইনে নিরীক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে নিরীক্ষা সেবায় অনিয়মের দায়ে নিরীক্ষককে জেল-জরিমানারও বিধান রাখা হয়েছে।  করপোরেট, পাবলিক, সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রণয়ন, হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা কাজে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিধানের উদ্দেশ্যে আইনটি করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, এফআরসি নিরীক্ষা খাতের নিয়ন্ত্রণে জটিলতা সৃষ্টি করবে উল্লেখ করে শুরু থেকেই প্রস্তাবিত আইনের বিরোধিতা করে আসছিল আইসিএবি। পরে দাতা সংস্থার চাপ ও সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কারণে এফআরএর বিষয়ে নমনীয় হয় স্বনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানটি। তবে ফিন্যান্সিয়াল অডিট-সংক্রান্ত আইনে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টদের অন্তর্ভুক্তি, অযোগ্যতার কারণে এফআরসির সদস্যপদ বাতিলে দুই হিসাব সংগঠনের সভাপতির মধ্যে বৈষম্য, সিভিল অপরাধের দায়ে নিরীক্ষকদের ফৌজদারি দণ্ডের বিধান ও আইনের খুঁটিনাটি কিছু অস্পষ্টতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আপত্তি প্রকাশ করে তারা। অন্যদিকে দেশের হিসাব পেশাদারদের অন্য সংগঠন ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনটির গুরুত্ব তুলে ধরে এতে সমর্থন দিয়ে আসছিল।

Leave a Reply