দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩ প্রকল্পে বড় অনিয়ম পেয়েছে আইএমইডি

জেসমিন মলি ও মাসুম বিল্লাহ | ২০১৫-০৮-৩০ ইং

www.bonikbarta.comঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র অথবা গ্রামীণ রাস্তায় নির্মিতব্য সেতুর নকশা প্রণয়ন থেকে স্থান নির্বাচন, নির্মাণ পর্যবেক্ষণ— সর্বত্র খামখেয়ালিপনা, অভিভাবকহীনতা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন তিনটি প্রকল্পে এমন নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালোচনায়। সম্প্রতি সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটির ১৬তম সভায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

সভায় জানানো হয়, গত অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিল। এর মধ্যে আটটি বিনিয়োগ ও তিনটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প। সে বছর আইএমইডি ওই মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্প পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সমাপ্ত প্রকল্প একটি এবং গত অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প দুটি।

প্রকল্পগুলো হলো— উপকূলীয় এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্রামীণ রাস্তায় ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মাণ এবং গ্রামীণ রাস্তায় ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মাণ। শেষোক্ত প্রকল্প দুটি গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো সম্পর্কিত হলেও এগুলোর বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

‘বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০১৫-এর জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভয়াবহ অনিয়মের খোঁজ পেয়েছে আইএমইডি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৯২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। বাকি ৫ শতাংশের মধ্যে কমপক্ষে নয়টি সাইটের তিনতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হলেও নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে না বলে আইএমইডি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটির সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প কার্যালয় থেকে ফোনে বা চিঠিতে অথবা পরিদর্শন করে অবকাঠামোর ত্রুটি সংশোধনের জন্য যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেগুলো প্রকল্প কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীরা সংরক্ষণ করেননি। বিক্ষিপ্তভাবে এসব ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। ফলে মাঠপর্যায় থেকে যারা এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে, তাদেরও তা অনুসরণ করতে অসুবিধা হয় বলে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্তের আওতায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো হস্তান্তর করে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব আশ্রয়কেন্দ্র ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় কিনা, তা নিয়ে কোনো তদারকি থাকে না এবং কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের ব্যবস্থাও নেয়া হয় না।

তৃতীয়ত. আশ্রয়কেন্দ্রগুলো অনেক ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের প্রথম আঘাত সয়ে থাকে। তাই ঘূর্ণিঝড়ের সমীপতা অনুযায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের উচ্চতা ও সহনক্ষমতা নিরূপণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রাথমিক আঘাতরেখার বাইরে নির্মিতব্য আশ্রয়কেন্দ্রের উচ্চতা ও সামর্থ্য দূরত্ব অনুপাতে কম হতে পারে। এ কারণে সব ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য একই নকশা প্রযোজ্য নয়। নির্মিতব্য আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থান ও দুর্গমতা বিবেচনা করে এর প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণের প্রয়োজন থাকলেও উল্লিখিত প্রকল্পটির ক্ষেত্রে এসবের কোনোটিই করা হয়নি বলে আইএমইডি মতামত দিয়েছে।

এছাড়া নির্মাণাধীন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ৪০০ থেকে ৪৫০ মানুষ ও ৩০০টি গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইএমইডির মতে, প্রকল্পের বরাদ্দ দিয়ে একতলা পিলারের ওপর সাড়ে ৭০০ বর্গফুটের ১৬-২০টি ঘূর্ণিঝড় সহনক্ষম দোতলা ঘর তৈরি করা সম্ভব। এসব ঘরে আশপাশের দেড় থেকে দুই হাজার লোক আশ্রয় নিতে পারবে। এভাবে আশ্রয়কেন্দ্র কাম-বাড়ি নির্মাণ করা হলে এগুলোর লক্ষ্য অর্জন ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হবে বলে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়।

মাঠপর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন ও তদারকির প্রধান দায়িত্ব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার হলেও আইএমইডি পরিদর্শনে দেখতে পেয়েছে উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রকল্পকাজে প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছে না। এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত ভবনের উপযোগিতাকাল (ইকোনমিক লাইফ) ডিপিপিতে উল্লেখ নেই। আবার দৃষ্টিগ্রাহ্য নামফলকও আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আইএমইডির পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. শাহ কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, আইএমইডি কোনো বিষয়ে সুপারিশ করলে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

আইএমইডি যেসব প্রকল্পে অনিয়ম পেয়েছে তার মধ্যে আরেকটি হলো, ২০১৩ সালে শেষ হওয়া ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্রামীণ রাস্তায় ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মাণ’। প্রকল্প এলাকা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা। প্রকল্পটিতে পূর্ণকালীন কোনো পরিচালক ছিলেন না বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে যে পরিচালককে প্রকল্পটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তিনি একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্প এলাকায় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নেই। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাজের তদারকি যথাযথভাবে করা হয়নি। পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের কাজে দক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেখা গেছে।

এ বিভাগের পরিদর্শন করা আরেকটি প্রকল্প হলো, গ্রামীণ রাস্তায় ছোট ছোট সেতু/কালভার্ট নির্মাণ। এটি তৃতীয়বারের সংশোধিত প্রকল্প। প্রকল্পটি মানিকগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও হবিগঞ্জ জেলায় বাস্তবায়নাধীন। প্রকল্পটির পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু কিছু ব্রিজ/কালভার্টের দৈর্ঘ্য প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশস্ত করা হয়নি। অনেক অ্যাপ্রোচ সড়কে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেয়ায় বৃষ্টির পানিতে মাটি সরে গেছে। এছাড়া অ্যাপ্রোচ সড়কের দুই পাশের উইং ওয়াল-সংলগ্ন স্থানের মাটি বৃষ্টির পানিতে সরে যাওয়ায় জনগণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে এবং যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, বেশকিছু সেতু ও কালভার্ট প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উঁচু করা হয়েছে। ফলে অ্যাপ্রোচ সড়কে মাটি ধরে রাখা যাচ্ছে না। এজন্য ভ্যান-রিকশা ও পণ্যবাহী গাড়ি সেতুর ওপর উঠতে সমস্যা হচ্ছে। সেতু ও কালভার্টের উভয় পাশের রাস্তা ইট দিয়ে বাঁধানো হয়নি। ফলে বর্ষাকালে মাটি সরে গিয়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। নির্মিত প্রায় সব সেতু ও কালভার্টে প্রচুর সংখ্যায় হানিকম্ব বা জলনিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিদ্র রাখা হয়েছে এবং অধিকাংশ ব্রিজ-কালভার্টের গঠনপ্রণালি ভালো হয়নি।

প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সদস্যদের তৎপরতা আশাব্যঞ্জক ছিল না বলে মন্তব্য করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার উপকারভোগীরা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকালে তাদের অভিযোগ ও চাহিদার বিষয়টি জানানোর মতো কোনো পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ডিআরআরওদের অবহেলা পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থার অধীনে বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে আরো সমন্বয় আনা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় ব্রিজ ও কালভার্টের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হয়নি।

এসব ত্রুটি সারাতে ব্রিজ ও কালভার্টের উচ্চতা প্রকল্প এলাকার উপযোগিতা মোতাবেক নির্ধারণের সুপারিশ করেছে আইএমইডি। পাশাপাশি ব্রিজের উভয় পাশের রাস্তার ঢাল শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি করার কথা বলা হয়েছে।

Leave a Reply