দুর্বল তদারকিতে কমছে না রেল দুর্ঘটনা
জেসমিন মলি | ২০১৫-০৮-২১ ইং
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেড় বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৬৮টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলওয়ের হিসাবে এসব দুর্ঘটনায় সাতজনের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু প্রতিবারই দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিকে তিরস্কারের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। এতে বাড়তে থাকে অবহেলা; যার ফল হিসেবে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।
চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় রেল দুর্ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্কারবিহীন অবকাঠামো, চালকের গাফিলতি, যন্ত্রাংশে ত্রুটি ও রেলপথ অরক্ষিত থাকায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গত দেড় বছরে দায়িত্বে অবহেলার কারণে মাত্র পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক তিরস্কার, সামান্য অর্থদণ্ড ও সাময়িক দায়িত্ব পালনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়ীদের শাস্তি বিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারায় রেলে দুর্ঘটনাও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে।
নির্ধারিত গতির চেয়ে অতিরিক্ত গতিতে ট্রেন চালানোয় ২০১৪ সালের ১ মার্চ চট্টগ্রামের হাসেমপুর সেকশনে দোহাজারী পিডিবি শাটলের সামনের চার চাকা লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় রেলের যান্ত্রিক লোকো বিভাগের এক কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি রেলওয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে। অথচ এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তি হিসেবে শুধু তিরস্কারের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।
গত ১৯ জুন চট্টগ্রাম দোহাজারী সেকশনে রেল সেতু ভেঙে ইঞ্জিনসহ তিনটি ফার্নেস অয়েল বোঝাই ওয়াগন বোয়ালখালী খালে পড়ে যায়। এর মধ্যে দুটি ওয়াগন তলিয়ে যায় পানির নিচে। দোহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের জন্য জ্বালানি তেল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এসব ওয়াগনে। দুর্ঘটনার পর বিপুল পরিমাণ তেলও পড়ে খাল ও নদীতে।
দেশের অন্যতম প্রাচীন ওই রুটে তেলবাহী ট্রেনে গত এক বছরে চারবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখনো এ ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি রেলওয়ে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজন দায়ী থাকে। অধিকাংশ সময়ই সিগনাল অমান্য করে রেলপথের ওপর উঠে পড়ে বিভিন্ন যানবাহন। এজন্য রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করে। তবে কখনো রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে রেল আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, রেলের দোহাজারী রুটে অয়েল ট্যাংকার দুর্ঘটনা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই আটটি ফার্নেস অয়েল ভর্তি ট্যাংকার নিয়ে একটি ওয়াগন ট্রেন দোহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্টের উদ্দেশে রওনা হয়। জালালী হাট এলাকায় ওয়াগনটির তিনটি ট্যাংকার লাইনচ্যুত হয়। নড়বড়ে লাইনের কারণে উদ্ধারকারী ক্রেন পৌঁছতে না পারায় দুর্ঘটনায় হেলে পড়া ট্যাংকার থেকে খালি ট্যাংকারে ফার্নেস অয়েল পাইপের মাধ্যমে রি-ট্রান্সশিপের মাধ্যমে বিদ্যুেকন্দ্রে পাঠানো হয়। এতে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। এর আগে ২৭ জুলাই একই রুটের পটিয়া উপজেলার কাঞ্চননগর এলাকায় আট ট্যাংকারের একটি ওয়াগনের তিনটি ট্যাংকার লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল পরিবহনে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দোহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্ট ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপককে তলব করে দ্রুত লাইন সংস্কারের নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদফতর।
গত ৯ জুলাই ফৌজদারহাট এলাকায় বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলবাহী একটি ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে বিপুল পরিমাণ তেল নিঃসৃত হয়।
রেলওয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের নাজিরহাট ও দোহাজারী রেলপথে ট্র্যাক সংস্কার, ব্রিজ, স্টেশন ও অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। দোহাজারী রুটের ২৪ নম্বর ব্রিজটি ২০০৫ সাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলেও তা মেরামতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। মূলত প্রকৌশল বিভাগের গাফিলতিতে চট্টগ্রামে বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায় সারে রেলওয়ে।
Leave a Reply