ই-কমার্স সাইটে নকল পণ্য
জেসমিন মলি | ২০১৫-০৫-১১ ইং
বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে অনলাইন মার্কেট প্লেস আজকের ডিল থেকে বাংলাদেশ দলের জার্সির একটি রেপ্লিকা কেনেন আরাফাত হোসেন (ছদ্মনাম)। এজন্য বাড়তি দামও পরিশোধ করেন তিনি। পণ্য বুঝে নেয়ার সময় দেখেন, তাকে অত্যন্ত নিম্নমানের একটি জার্সি সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি পণ্যটি তত্ক্ষণাৎ ফেরত পাঠান এবং আজকের ডিলে অভিযোগ জানান। পরবর্তীতে তাকে জানানো হয়, যে বিক্রেতা পণ্য সরবরাহ করেছিলেন, তার নামে অনেক অভিযোগ থাকায় তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো প্রতিকার পাননি এ ক্রেতা।
দেশে জনপ্রিয় আরেকটি ই-কমার্স সাইট ক্লিক বিডি ডটকম। এ সাইট থেকে একটি ট্যাবলেট পিসি কেনার অর্ডার দেন জুবায়ের নামে এক ক্রেতা। বিক্রেতার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকাও পাঠান তিনি। বিক্রেতাও কুরিয়ারের মাধ্যমে পণ্য পাঠিয়ে দেন জুবায়েরের ঠিকানায়। কিন্তু নতুন পণ্যের কথা বলে পুরনো ও নষ্ট একটি ট্যাবলেট পিসি পাঠানো হয়। পরে বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে সেলফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ক্লিকবিডি ডটকমে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি তিনি।
ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ই-কমার্স সাইটগুলোর বিরুদ্ধে নকল পণ্য সরবরাহসহ প্রতারণার অভিযোগ নেহাত কম নয়। দেশে অনলাইনে কেনাকাটা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রতারণার ঘটনাও। নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, এক পণ্য অর্ডার দিলে অন্য পণ্য সরবরাহ, এমনকি দাম পরিশোধের পর পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ রয়েছে এসব সাইটের বিরুদ্ধে; যা শুরুতেই আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে সম্ভাবনাময় খাতটিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে না আনা এবং ভোক্তা অধিকারের বিষয়টিতে নজরদারি না বাড়ানোর কারণে এসব প্রতারণার ঘটনা ঘটছে।
এসব বিষয়ে বেসিস সভাপতি শামিম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সেবা দেয়ার সময় অনেক ঝুঁকি থেকে যায়। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টিতে এখন নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে ক্রমপ্রসারমাণ অনলাইন শপিংয়ের ব্যাপ্তি আরো বাড়াতে জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়সহ তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ করছে ই-কমার্স সাইটগুলো। সম্প্রতি আজকের ডিল ডটকম অনলাইন শপিং সেন্টারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা। শুধু মাশরাফি বিন মর্তুজা নন, সম্ভাবনাময় অনলাইনভিত্তিক শপিংকে জনপ্রিয় করতে এ খাতের ব্যবসা প্রসারে যুক্ত হচ্ছেন দেশের আইকনিক অনেক ব্যক্তিত্ব। এসব সাইটের মানসম্পন্ন পণ্য বিক্রির বিষয়ে তারা নিশ্চিত হচ্ছেন কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা শরিফুল ইসলাম বলেন, সারা পৃথিবীতে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রসারের জন্য ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ অহরহ হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার কিছু বিষয়ে তারা একমত হয়েই প্রচারণার কাজটি করে থাকেন। আইকনিক ব্যক্তিত্বকে পণ্যদূত হিসেবে দায়িত্ব দিলে গ্রাহকের প্রাথমিক আস্থার জায়গাটি পাওয়া যায়। তবে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে ভোক্তার অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস মুখ্য ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল পণ্য বিক্রি ভোক্তা অধিকারের লঙ্ঘনই কেবল নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধও। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির এ বিষয়ে বলেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হলে জেল-জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিরই বিধান রয়েছে। বিদ্যমান আইনে সাজার ব্যবস্থা থাকায় নতুন করে নীতিমালা তৈরির প্রয়োজন পড়বে না।
উল্লেখ্য, প্রতারণার মাধ্যমে পণ্য বিক্রির শাস্তি নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনে যেসব অপরাধে জরিমানার বিধান রয়েছে, তার মধ্যে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি কিংবা সরবরাহ না করার বিষয়টিও রয়েছে। এসব অপরাধের জন্য এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অনধিক ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির ভূঁইয়া বলেন, আইনে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দণ্ডবিধির পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনেও শাস্তির বিধান রয়েছে। আইন অনুযায়ী একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তির মাত্রা হবে দ্বিগুণ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশী বহুল প্রচারিত অনলাইন পোর্টালে পণ্য বিক্রির সুযোগ পেতে হলে বিক্রেতাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হয়। এসব তথ্য সঠিকভাবে যাচাইয়ের পরই কেবল একজন বিক্রেতা পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। এ কারণে এসব অনলাইন পোর্টাল থেকে ক্রেতারা নিরাপদে কেনাকাটা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল ইবে ১ হাজার ডলার পর্যন্ত কেনাকাটা করার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। কোনো কারণে বিক্রেতা পণ্য না পাঠালে বা যোগাযোগ না করলে ইবে ১৫ দিনের মধ্যে সেই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে দেয়। পরে সংশ্লিষ্ট বিক্রেতার নামে মামলা করা হয়। এক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ইবে। তবে দেশে এখনো এ ব্যবস্থা চালু হয়নি।
জানা গেছে, ২০০৬ সালে দেশে প্রথমবারের মতো অনলাইনে বেচাকেনা শুরু হয়। আর ২০১০ সালে বেসরকারি ব্যাংক ডাচ্-বাংলা সর্বপ্রথম ই-পেমেন্ট সুবিধা চালু করে। আর ২০০৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইনে কেনাকাটার অনুমতি দেয়। শ্রেণীভুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ই-কমার্সভিত্তিক সেবা দিতে বেশ কয়েকটি সাইট রয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে— বিক্রয় ডটকম, লামুদি ডটকম ডটবিডি, এখানেই ডটকম, ক্লিকবিডি ডটকম ও রকমারি ডটকম।
Leave a Reply