সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে ১৮৬ কোটি টাকা ঋণ আল-আমিন গ্রুপ এমডির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

জেসমিন মলি ও সুমন ভৌমিক | ২০১৫-০১-০১ ইং

www.bonikbarta.comশিল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে বন্দোবস্ত নেয়া সরকারি জমি বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ নিয়েছে আল-আমিন গ্রুপ। প্রায় ৩০ একর জমির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৮৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার মির্জা। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চালানো অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জানা গেছে, গত সোমবার নোয়াখালীর সুধারাম মডেল থানায় দুদক নোয়াখালীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক নিরাপদ স্বর্ণকার বাদী হয়ে আল-আমিন গ্রুপের এমডি আনোয়ার মির্জাকে আসামি করে এ মামলা করেন।

দুদকের এ উপপরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, আল-আমিন গ্রুপের এমডি  মিথ্যা তথ্য দিয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ৬০ কোটি ৯২ লাখ টাকার ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি বন্দোবস্ত নেন এবং তা আত্মসাতের চেষ্টা করেন। বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে এসব সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ  নেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।

মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে সুধারাম মডেল থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, ৩৪/৪৩৫ নম্বর মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে এবং এখতিয়ার অনুযায়ী এ মামলা তদন্ত করবে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আল-আমিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আল-আমিন সুইট অ্যান্ড ক্র্যাকার্স ও নোয়াখালী বেভারেজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালে সরকারি বন্দোবস্ত জমির বিপরীতে বিভিন্ন সময় ঋণ নিয়েছেন আনোয়ার মির্জা। ব্যাংকঋণ নেয়ার জন্য নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের একটি ভুয়া অনাপত্তিপত্রও তৈরি করেন তিনি।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালের দিকে আনোয়ার মির্জা ফারহানা টেক্সটাইল মিলস ও নোয়াখালী অয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য নোয়াখালীর বিনোদপুর, কাশিরামপুর, পশ্চিম কৃষ্ণপুর ও পূর্ব রামচন্দ্রপুর মৌজার বিভিন্ন দাগে ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি বন্দোবস্তের আবেদন করে। পরবর্তী সময়ে তত্কালীন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক তাকে জমির বন্দোবস্ত নথি প্রদান করেন। ওই বন্দোবস্ত নথি দুটোর আলোকে ১৯৯৪ সালের ৯ মে ৮৩২১ ও ৮৩২২ যুক্তে দুটি কবুলিয়ত সম্পাদন করেন। কবুলিয়ত দুটি সম্পাদনের সময় সরকার কর্তৃক ১৭টি শর্ত আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ব্যতীত আবেদিত শিল্প ছাড়া অন্য কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া এবং ভূমির আকার পরিবর্তন করা যাবে না।’ ১১ নম্বর শর্তে রয়েছে, ‘কোনো প্রকার বিল্ডিং করা যাবে না’। ১৩ নম্বর শর্তে উল্লেখ রয়েছে, ‘লিজ জমিতে কবুলিয়ত রেজিস্ট্রারের তারিখ হতে এক বত্সরের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লক্ষ্যে সন্তোষজনক পদক্ষেপ জেলা প্রশাসককে দেখাতে হবে এবং উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিতে ব্যর্থ হইলে বন্দোবস্ত সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে। তখন কবুলিয়তের শর্ত মেনে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষরও করেন।’

অঙ্গীকারপত্রের ১ নম্বর শর্তে বলা হয়, ‘বন্দোবস্ত প্রাপ্ত ভূমিতে কবুলিয়ত রেজিস্ট্রারির তারিখ হতে এক বত্সরের মধ্যে ফারহানা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও নোয়াখালী ওয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেডের নামে শিল্প কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিব এবং উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করিতে ব্যর্থ হলে বন্দোবস্ত সরাসরি বাতিল বলিয়া গণ্য হবে। এ ব্যাপারে কোনো রূপ ওজর আপত্তি করিব না, করিলেও উহা সর্ব আদালতে অগ্রাহ্য হবে।’ ৬ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ‘বন্দোবস্তকৃত ভূমি প্রস্তাবিত কাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করিব না।’

কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে— বন্দোবস্ত নথি ও তত্সংক্রান্ত অঙ্গীকারপত্রের সব শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। বন্দোবস্তকৃত স্থানে উল্লিখিত দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। এছাড়া উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য সরকারের বিনিয়োগ বোর্ডের আইন মানা হয়নি।

শিল্পনীতি ১৯৯১ অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের জন্য বেসরকারি শিল্পকে বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু আল-আমিন গ্রুপের এমডি আনোয়ার মির্জা উল্লিখিত দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেলায় বিনিয়োগ বোর্ডে কোনো প্রকার আবেদন করেননি এবং কোনো নিবন্ধনও নেননি। ফলে সরকারের ৩০ দশমিক ৪৬ একর ভূমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারণা করেন। বন্দোবস্ত ভূমিতে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কবুলিয়তের শর্ত ও অঙ্গীকারপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে তিনি ওই স্থানে আল-আমিন সুইট অ্যান্ড ক্রেকার্স ও নোয়াখালী বেভারেজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যার অস্তিত্ব বর্তমানে নেই।

দুদক নোয়াখালী কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আল-আমিন গ্রুপের এমডি নোয়াখালীর বিনোদপুর, কাশিরামপুর, পশ্চিম কৃষ্ণপুর ও পূর্ব রামচন্দ্রপুর মৌজার বিভিন্ন দাগে যে ভূমি ফারহানা টেক্সটাইল মিলস এবং নোয়াখালী অয়েল রিফাইনারি মিলস লিমিটেড স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছেন তা বেআইনি। কারণ সরকারের ভূমি হুকুম দখল ৩২/১৯৬২-৬৩, ৩২/১৯৬৩-৬৪ নম্বর  নথি যুক্তে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালী নামে রয়েছে। আনোয়ার মির্জা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই সম্পত্তি দখল করে রেখেছেন।

 

Leave a Reply