অসামর্থ্যের কারণেই ফ্ল্যাটের ক্রেতা কম

জেসমিন মলি | ২০১৪-১১-২৯ ইং

ফ্ল্যাটের দাম গত কয়েক বছরে কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তার পরও অবিক্রীত পড়ে আছে হাজার হাজার ফ্ল্যাট। মন্দায় পড়া আবাসন খাতটি পুনরুজ্জীবিত করতে ফ্ল্যাট কেনায় অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগও দিয়েছে সরকার। কিন্তু আগ্রহীদের অসামর্থ্যের কারণে বাড়ছে না ফ্ল্যাটের ক্রেতা। সম্প্রতি অনলাইনে ফ্ল্যাট কেনাবেচার সাইট লামুডির এক জরিপে বলা হয়েছে, আগ্রহ থাকলেও সামর্থ্যের অভাবে ফ্ল্যাট কিনতে পারছে অধিকাংশ মানুষ।

www.bonikbarta.comবাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে চান, এমন শ্রেণীর মানুষের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত এ জরিপে বলা হয়, ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করে, তাদের ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য নেই। আর প্রায় ১০ শতাংশ প্রতারণার ভয়ে শঙ্কিত এবং ২২ শতাংশ অন্যান্য কারণে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী নয়।

ঢাকার সেগুন বাগিচার এক সরকারি কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ খান। বাড়িওয়ালার নানা অনুশাসনের কারণে নিজের ফ্ল্যাটে থাকতে চান। কিন্তু অনেকেরই সেই সামর্থ্য নেই। তিনি বলেন, বিদেশে এ ঋণের সুদ কম, ফ্ল্যাট ও বাড়ির দাম যৌক্তিক। এ কারণে ঋণ করে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনলে বাড়িভাড়ার সঙ্গে অল্প কিছু যোগ করে ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে এক সময় ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায়। কিন্তু দেশে এটা সম্ভব নয়। কারণ ফ্ল্যাটের দাম ও ঋণের সুদ আকাশছোঁয়া। অস্বাভাবিক আয় না থাকলে এখানে বেশির ভাগ মানুষই ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী হন না।

এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকারিভাবেও আবাসনব্যবস্থা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখন থেকে জমি বা প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। এজন্য কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে আরো ফ্ল্যাট নির্মাণে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ মাথাগোঁজার ঠাঁই পাবে।

এদিকে সংকটের মধ্যেও আবাসন খাত নিয়ে আশাবাদী ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকার ফ্ল্যাট কিনতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। ক্রেতারা যদি এ সুযোগ গ্রহণ করেন, এ খাত আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠবে।

মাথাগোঁজার জন্য ঢাকায় পছন্দের একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তানভীর চৌধুরী। কিন্তু ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ লাভজনক মনে করছেন না তিনি। তার মতে, ঢাকার লালমাটিয়ায় ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ১ কোটি টাকা। এ মানের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। ১ কোটি টাকা ব্যাংক অথবা অন্য যে কোনো খাতে বিনিয়োগ করলে অনায়াসে মাসে ১ লাখ টাকা পাওয়া যায়, যা দিয়ে ফ্ল্যাটের ভাড়াসহ পুরো সাংসারের খরচ মেটানো সম্ভব। তিনি বর্তমান বাজারদরে ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহী নন।

জরিপে বলা হয়, ৫২ শতাংশ মানুষ এখনো ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী। আর ৪৮ শতাংশ ভাড়া ফ্ল্যাটেই থাকতে চান। ফ্ল্যাট কেনা অথবা ভাড়া নিতে আগ্রহীদের প্রথম বিবেচনার বিষয় নিরাপত্তা। এর পর স্থান ও ভাড়া। যারা ফ্ল্যাট কিনতে চান, তাদের ৭৩ শতাংশ মনে করে, নিরাপত্তাজনিত কারণে ফ্ল্যাট কেনা প্রয়োজন। বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নিয়ে বাড়ি কিনতে উদ্যোগী এমন মানুষের সংখ্যা ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

জরিপে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের আবাসন খাতের ৮৮ শতাংশ বাজারই রাজধানী ঢাকায়। চট্টগ্রামে প্রায় ১১ শতাংশ বাজার থাকলেও অন্যান্য বিভাগীয় শহরে তা ১ শতাংশেরও কম। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বসবাসের জন্য সবাই এ দুই শহরকেই বেছে নেন। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষাসহ অন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় অন্য শহরের তুলনায় এগিয়ে থাকার কারণেই বসবাসের জন্য শহর দুটি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ দুই শহরে মধ্যম আয়ের মানুষের বসবাস দ্রুত গতিতে বাড়ছে।

বাড়তি দামের কারণে ক্রমেই আবাসন শিল্প ঢাকার বাইরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। লামুডির গবেষণায় আবাসনে চাহিদার পরবর্তী গন্তব্য উত্তরা বলে মন্তব্য করা হয়েছে। অবস্থানগত দিক বিবেচনায় উত্তরার স্যাটেলাইট টাউনের প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। উচ্চবিত্তদের বসবাসের স্থান হিসেবে পরিচিত গুলশান রয়েছে পরবর্তী তালিকায়। খোলা জায়গা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে বসুন্ধরা-বারিধারা রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে।

এ বিষয়ে রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের (এসইএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুল আউয়াল বলেন, কয়েক বছর ধরেই আবাসন ব্যবসা ঢাকার বাইরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সাধারণত বড় ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাইরে যেতে চান না। তবে এখন অনেকেই ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। এটি আবাসন খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক। নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ঢাকার বাইরেও প্রচলিত হলে এ খাতের ব্যবসা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

আবাসন ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগেও আবাসন খাতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সুযোগ ছিল। ফ্ল্যাটের দাম ছিল তুলনামূলক কম, বিক্রিও ছিল ভালো। তবে হঠাৎ অনেক ব্যবসায়ী এখানে বিনিয়োগ শুরু করলে এ খাত অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বেড়ে যায় জমির দাম। এর প্রভাব পড়ে ফ্ল্যাটের দামে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব শহর দ্রুত বর্ধনশীল, সেখানে রিয়েল এস্টেট প্রপার্টির দাম বাড়তে থাকে, কৃত্রিমভাবেও দাম বাড়ানো হয়। তখন অনেক ব্যবসায়ী এ খাতে আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন। ২০০৯ সালের পর দেশে আবাসন খাতের চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন ডেভেলপাররা এ খাতে ব্যবসা শুরু করেন। রিহ্যাব সূত্র বলছে, ১০ বছর আগে সংগঠনটির সদস্য ছিল ১৫০, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০।

 

Leave a Reply