বুয়েটের গবেষণা ঢাকা শহরের ৭৩% উন্নয়নই অপরিকল্পিত

জেসমিন মলি | ২০১৪-০৭-০৭ ইং

অপরিকল্পিত অবকাঠামোর বোঝা কাঁধে নিয়ে যানজট আর জলাবদ্ধতার শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। ভূমি ব্যবহারের যথাযথ নীতিমালা না মেনে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। নগরীতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

www.bonikbarta.com
বুয়েটের এ গবেষণায় দেখানো হয়, জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে ওঠা অপরিণামদর্শী উন্নয়নের ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে রাজধানীর পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা। অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থার কারণে বিপর্যস্ত পরিবহন খাতও। শহরের বাসিন্দাদের  নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। এখানে মোট সড়কের আয়তন ১ হাজার ২৮৬ কিলোমিটার। তার ৫২ শতাংশই আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।
গবেষক দলের প্রতিনিধি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক এসএম সোহেল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে জানান, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় ঢাকা শহরে নিত্যদিনের ভোগান্তি বাড়ছে। প্রধান সড়ককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে ওঠায় যানজটের প্রকোপ বেড়েছে। জলাবদ্ধতার কারণও অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের উন্নয়নে কার্যকর কোনো নীতিমালা না থাকায় যেখানে সেখানে গড়ে ওঠা এ অবকাঠামোর ফলে ভূমির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ১৯৫৯ সালে মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এ শহর। নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্যের কারণে এ শহরের অবকাঠামো উন্নয়নে সে প্ল্যানও অনুসরণ করা হয়নি। ওই সময়ের তুলনায় এখন জনসংখ্যা বেড়েছে ৩০ গুণ। সে অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যান আধুনিকায়ন করা হয়নি, যার প্রভাব পড়েছে  অন্যান্য উন্নয়নে।
ঢাকার যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। সে অনুযায়ী সড়ক না থাকার কারণে যানজট বেড়েছে বহুগুণ। শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধান দফতর ও বিমানবন্দর পরোক্ষভাবে যানজট বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ নাজুক পরিস্থিতি উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিয়েছে ঢাকা শহরের অধিবাসীদের। যানজট কমাতে স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও মিলছে না তার সুফল। বরং এসব উদ্যোগ এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর। দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ছাড়া এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নীতিমালা মেনে অবকাঠামো গড়ে তোলার মতো উঁচু জমি নেই রাজধানীতে। এখানকার মাত্র ২৫ শতাংশ ভূমি স্থাপনা নির্মাণের উপযুক্ত। বাকি অংশ নিম্নাঞ্চল বা বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ ঝুঁকির মধ্যেই অবকাঠামো নির্মাণ করায় প্রতি বছর প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ১৩৩টির বেশি পাম্প রয়েছে। এসব পাম্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উদ্বেগের।
বর্তমানে ঢাকা শহরের ৬২ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ভূমিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং  বাকি ৩৭ শতাংশে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ৮ শতাংশ ভূমিতে বাণিজ্যিক ও ৯ শতাংশে প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।  ৪ শতাংশ জায়গায় উন্মুক্ত জলাশয়সহ ১০ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে সেনানিবাস এবং  ২ শতাংশে  বিমানবন্দর। পরিকল্পিত কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বড় বড় প্রশাসনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমানবন্দর। শহরের ১২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা প্রভাব ফেলছে সামগ্রিক উন্নয়নে।
এদিকে ঢাকা শহরে দিন দিন কমছে গাছপালা ও খোলা জায়গার পরিমাণ। প্রথম মাস্টারপ্লানে ৫ শতাংশ খোলা জায়গা ছিল। গত ৫৪ বছরে খোলা জায়গার পরিমাণ কমে পৌঁছেছে ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে।
এ বিষয়ে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজধানী ঢাকার মতো অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রায় ৪০ বছর সময় নিয়ে ঢাকা শহরের জন্য একটি মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করা হলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ কারণে জনজট, যানজট এবং জলজট বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ঢাকার মতো জনবহুল শহরের জন্য একটি নগর পরিকল্পনা খুবই জরুরি। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে গড়ে ওঠা ভবনের জন্য এ শহর বসবাসের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিশীলিত নগরায়ণের জন্য শিগগিরই বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী এগোতে হবে। তা না হলে ঢাকা শহরকে রক্ষা করা ক্রমেই দুরূহ হবে।

Leave a Reply