রাজউক থেকে শতাধিক ভবনের নকশা গায়েব

জেসমিন মলি | ২০১৪-০৯-১৪ ইং

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কার্যালয় থেকে শতাধিক বহুতল ভবনের নকশা হারিয়ে গেছে। এসব ভবনের অধিকাংশই ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে নয়তলা বা তারও বেশি উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে। এ জালিয়াতির তথ্য গোপন করতেই অনুমোদনপ্রাপ্ত ভবন মালিকদের যোগসাজশে রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা এসব নকশা অনুমোদনের নথি গায়েব করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি জালিয়াতির মাধ্যমে বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজউকের কাছে সংশ্লিষ্ট ভবনের নথি তলব করলে নকশা গায়েবের বিষয়টি উঠে আসে।

www.bonikbarta.com

সূত্র জানায়, বহুতল ভবন নির্মাণে জালিয়াতি অনুসন্ধানের প্রয়োজনে গুলশানের জব্বার টাওয়ার, বনানীর ইকবাল টাওয়ার, উত্তরার নাটোর টাওয়ারসহ শতাধিক ভবনের নকশা অনুমোদনের নথি চেয়ে রাউজককে চিঠি দেয় দুদক। বারবার চিঠি পাঠানোর পরও রাজউক তা সরবরাহ করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে রাজউকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এসব ভবনের নকশাসংবলিত নথি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শতাধিক বহুতল ভবনের নথি গায়েব করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য ভবন           নির্মাণের নথি তলব করা হলেও তা সরবরাহ করতে পারেননি রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতির তথ্য গোপন করতেই জালিয়াতির মাধ্যমে নির্মিত এসব ভবনের নকশা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান জানান, রাজউকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ বন্ধ করতে কাজ করছে দুদক। রাজউকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় একশ্রেণীর আবাসন ব্যবসায়ী বিভিন্ন অনিয়মের সুযোগ করে নেন। রাজউকের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে এসব অনিয়মও দূর হবে।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ভবন নির্মাণ বিধিমালার আওতায় রাজধানীতে বিভিন্ন স্থাপনার অনুমোদন দেয়া হয়। এসব ভবন অনুমোদনের তালিকা অনুযায়ী অনুসন্ধান চালিয়ে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, অনুমোদনপ্রাপ্ত ভবনের চেয়ে অতিরিক্ত উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিষয়টি বিশদ অনুসন্ধানের জন্য নকশার নথি তলব করলে রাজউক থেকে জানানো হয়, এসব ভবনের নকশা রাজউকের স্টোর থেকে হারিয়ে গেছে।

এর আগেও একবার ৫৭টি ভবনের নকশা অনুমোদনসংক্রান্ত নথি গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল রাজউকে। তখন নথি গায়েব অথবা নষ্ট করার অভিযোগে রাজউকের দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুদক।

নথি হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে জানান, নথি হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগে রাজউকের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজউকের দুর্নীতি দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব দুর্নীতি একদিনে দূর হবে না। তবে ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।

রাজউক অনুমোদিত নকশাবহির্ভূত বাড়ি নির্মাণ নিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দুদক প্রায় দেড় হাজার ভবন নির্মাণের সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করে। সরেজমিনে ২০০টি ভবন পরিদর্শন করেন দুদক কর্মকর্তারা। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দুদক জানতে পারে, অনুমোদিত নকশাবহির্ভূতভাবে ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকায় নয় হাজার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অনুমোদনহীন এসব ভবন নির্মাণে বিভিন্ন বেসরকারি ডেভেলপার ও সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকরা জড়িত।

দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে বেশকিছু আবাসন প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে— রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট, ডম-ইনো বিল্ডার্স লিমিটেড, বিল্ডিং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেড (বিডিডিএল) ও বোরাক রিয়েল এস্টেট। এছাড়া ছোট আকারের যেসব আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাও রাজউকের নিয়ম ফাঁকি দিয়ে বা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে স্থাপনা তৈরি করে আসছেন। কিন্তু নকশার পরিবর্তন ও অনুমোদনের অতিরিক্ত উচ্চতার ভবন নির্মাণের বিষয়ে রাজউক দায়সারা গোছের নোটিস দিয়ে তাদের কার্যক্রম শেষ করে। সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না প্রতিষ্ঠানটি। আবার অনেক সময় ভবন মালিকরা রাজউকের অনুমোদনের অতিরিক্ত অংশ ভাঙার নোটিস পেলেও হাইকোর্টে রিট করে ভবন ভাঙা স্থগিত করেন। দুদক কর্মকর্তাদের মতে, এসব এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।

নকশা জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে কয়েকজন আবাসন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসা না বুঝেই যারা এ খাতে বিনিয়োগ করছেন, তারাই সাধারণত এসব অনিয়মে জড়িত। বাড়তি লাভের জন্য এসব ব্যবসায়ী অনুমোদনের অতিরিক্ত স্থাপনা তৈরি করছেন। এসব স্থাপনা যে ঝুঁকি তৈরি করে, তা তারা বুঝতে চান না।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘অনুমোদনের বাইরে অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আরো সতর্ক হতে হবে। রিহ্যাব থেকেও আমরা অনুমোদনের বাইরে গিয়ে ভবন তৈরি না করার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছি।’

Leave a Reply