প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়াধীন হচ্ছে দোয়েল ল্যাপটপ প্রকল্প

জেসমিন মলি

ডুবন্ত দোয়েল ল্যাপটপ প্রকল্প বাঁচাতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এ ল্যাপটপের বিপণন বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পটি তদারক করা হবে। নতুন এ উদ্যোগের ফলে প্রকল্পটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

www.bonikbarta.com

সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই), তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদফতর এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি দোয়েল ল্যাপটপ প্রকল্পের সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে দোয়েল ল্যাপটপ প্রকল্পকে কীভাবে স্থানীয় বাজারে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে আইসিটি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। ভর্তুকি নিয়ে নয়, ব্যবসা সফল ব্র্যান্ড হিসেবে এটিকে এগিয়ে নিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও তার নিয়মিত আপগ্রেডেশনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এছাড়া বিপণন ও বিক্রয়োত্তর সেবার উন্নয়নের মাধ্যমে ক্রেতার আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা হবে বলেও জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে জানান, দোয়েল ল্যাপটপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিপণন ব্যবস্থা বাড়াতে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কমিটি দোয়েল ল্যাপটপের যাবতীয় বিষয় তদারক করবে। তাদের পর্যবেক্ষণ দেশের বাজারে দোয়েল ল্যাপটপের বিক্রি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এ ল্যাপটপে প্রযুক্তিগত যেসব ত্রুটি ছিল, ক্রমান্বয়ে তাও দূর করতে এ কমিটি কাজ করবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর দেশে তৈরি ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ যাত্রা করে। সবার হাতে ল্যাপটপ পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এ প্রকল্প শুরু হয়। কিন্তু অদক্ষতার কারণে সফল হতে পারেনি প্রকল্পটি। উত্পাদন শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে ল্যাপটপ তৈরির কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। আর গ্রাহকের অসন্তুষ্টি তো রয়েছেই। এখন এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সফলতার উপায় নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।

জানা গেছে, সাশ্রয়ী মূল্যে ল্যাপটপ তৈরির উদ্দেশ্যে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই এ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় চলে যায়। তুলনামূলক কম দামের নোটবুক ধরনের এ ল্যাপটপ তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় টেলিফোন শিল্প সংস্থা লিমিটেডকে (টেশিস)। চার ধরনের ল্যাপটপের দাম ধরা হয় ১০ থেকে ২৬ হাজার টাকা। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্পমূল্যের এসব ল্যাপটপ সরকারি সংস্থাগুলোয় সরবরাহ করা হয়। পরে সাধারণ মানুষের জন্য তা বাজারজাত করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেশিসের গাজীপুর কারখানায় ২০১১ সালের ১০ জুলাই দোয়েল ল্যাপটপের পরীক্ষামূলক উত্পাদন শুরু হয়। এ ল্যাপটপ তৈরির জন্য বিটিসিএল থেকে ৯৫ কোটি টাকা দেয়া হয় টেশিসকে। কারখানা তৈরির জন্য জমি দিয়ে সহযোগিতা করে সরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শ ও সহযোগিতায় মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান থিম ফিল্ম ট্রান্সমিশন (টিএফটি) এবং কয়েকজন বিদেশী বিশেষজ্ঞের সহযোগিতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করে টেশিস। ল্যাপটপের মাদার বোর্ডসহ শতকরা ৬০ ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি হয় দেশেই।

তবে দোয়েল ল্যাপটপ সাধারণ মানুষের হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে এর বিভিন্ন দুর্বলতা ধরা পড়ে। এ ল্যাপটপ অ্যান্ড্রয়েড ও লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এ দেশের মানুষ সাধারণত উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারে অভ্যস্ত। এ কারণে শুরুতে যে সাড়া দেখা দিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়ে। যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতি ও বিভিন্ন ত্রুটির কারণে চালুর ছয় মাসের মধ্যেই ল্যাপটপ উত্পাদন বন্ধ করে দেয় টেশিস।

তবে সংস্থাটি দাবি করেছে, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শেই প্রাইমারি মডেলটির উত্পাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। দলটি বর্তমানে প্রাইমারি মডেলের ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। নতুন মডেলে পূর্ণাঙ্গ ল্যাপটপের সুযোগ-সুবিধা সংযোজন করার প্রক্রিয়া চলছে। আগে এতে সিডিরম না থাকলেও এটি ছাড়া আরো কিছু নতুন সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সব মিলে গত দুই বছরে ৪২ হাজার ১৯৫টি ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ আমদানি করেছে টেশিস। এর মধ্যে ৩৭ হাজারটি সংযোজন করেছে তারা। আর বিক্রি হয়েছে মাত্র ২৮ হাজার ৬০০টি। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার ল্যাপটপ। সেনাবাহিনীও বেশ কিছু ল্যাপটপ নিয়েছে। এর বাইরে অবশিষ্ট আট হাজার ল্যাপটপ বাজারে বিক্রি করতে পারেনি টেশিস।

এদিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পাঁচ হাজার ল্যাপটপ সংযোজন করলেও দুই বছরে তারা বিক্রি করতে পেরেছে ৬৮৪টি। আবার অ্যাডভান্স-১৬১২ই মডেলের দুই হাজার ল্যাপটপ সংযোজন করা হলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৮৩টি। সব মিলে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ল্যাপটপ বিক্রি করতে সমর্থ হয়েছে সংস্থাটি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভর্তুকি দিয়ে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো সেদেশের সাধারণ মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যের টেকসই ল্যাপটপ তৈরি করছে। এসব দেশের আদর্শ অনুসরণ করেই ল্যাপটপ তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তবে সাধারণ ব্যবহারকারী এ ল্যাপটপ ব্যবহার করে বিপাকে পড়েছে।

দোয়েল ল্যাপটপ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুণগত মান ভালো না হওয়া এবং বিক্রয়োত্তর সেবা নিতে নানা ভোগান্তির কারণে সাধারণ গ্রাহক কোনো অবস্থায় এ ল্যাপটপ কিনতে আগ্রহী নয়।

এ বিষয়ে টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুসনুল মাহমুদ খান বলেন, ‘সীমিত আকারে এখনো ল্যাপটপ তৈরি হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা মুনাফার চিন্তা করি না। আমরা চাই, ব্যবহারকারীরা আমাদের ল্যাপটপ ব্যবহার করে সন্তুষ্ট হোক। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকা ও প্রচারণার অভাবে বেসরকারি পর্যায়ে ল্যাপটপের চাহিদা তৈরি সম্ভব হয়নি।’

উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত টেশিসে একসময় শুধু টেলিফোন সেটই তৈরি হতো। এখন ল্যাপটপ তৈরির পাশাপাশি সেলফোন সংযোজনের কাজও করছে প্রতিষ্ঠানটি।

Leave a Reply