দুর্নীতির পরম্পরা বিস্তৃত বেসরকারি ব্যাংকেও

জেসমিন মলি ও সাকিব তনু | ২০১৪-০৮-০৭ ইং

ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ছবিটা নিয়ে কেউই এখনো পুরোপুরি অবহিত নন। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ বা বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এর খণ্ডচিত্র মাত্র। ক্রেডিট কার্ডের মতো ছোটখাটো সেবা থেকে শুরু করে বড় ঋণপ্রাপ্তি সবই চলছে বাঁকা পথে। কোনো কোনো শাখা ব্যবস্থাপক গ্রাহকের জমা করা টাকা নিজের হিসাবে জমা করেছেন। আবার কেউ কেউ ভুয়া গ্রাহক হিসাব খুলে নিজের ব্যাংক থেকেই নিজে অর্থ আত্মসাৎ করছেন। যদিও নীতিনির্ধারক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সবাই খাতের কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট। অবশ্য গত তিন বছরে শুধু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায় দুই হাজার ঘটনার অনুসন্ধান করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হিসাবে এর পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।

এক্সিম ব্যাংকের কুমিল্লার লাকসাম শাখার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে নিজ প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন তিনি। দুদকের তদন্তের পর মামলা হয় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। পূবালী ব্যাংকের জামালপুর জেলার বকুলতলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান ও মো. আরিফ রব্বানী। তারাও ব্যাংকের হিসাব থেকে ঠিকাদারের বিলের জামানত, আয়কর ও ভ্যাট বাবদ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনায়ও গত বছর মামলা করে দুদক।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আগে রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাংকের ঢাকা ও চট্টগ্রামের শাখাগুলোয় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ বিভাগকেও অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধানসহ শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়ছেন এসব অনিয়মে। অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে আবার সহজেই অন্য ব্যাংকে যোগদানের সুযোগও পেয়ে যাচ্ছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এ প্রবণতা বাড়ছে। পাশাপাশি নয়টি নতুন ব্যাংক আসায় এ সুযোগ আরো উন্মুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে অনিয়মের জন্য অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাই মূলত দায়ী। বিদেশী ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় সেখানে অনিয়ম কম হচ্ছে। তবে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা সৎ এবং দক্ষ হলে এটা কমে আসবে। অনিয়মের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক রীতিও অনেকাংশে দায়ী।

দুদকের তথ্যমতে, ইসলামী ব্যাংকের কক্সবাজারের চিরিঙ্গা শাখা ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম গ্রাহকের সহযোগিতায় প্রায় ৬ কোটি ৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। একই গ্রাহকের সহযোগিতায় প্রায় ৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চকরিয়ার শাখা ব্যবস্থাপক মোজাম্মেল আলম চৌধুরী। খুলনার কর্মসংস্থান ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক (বর্তমানে বরখাস্ত) সুলতান আহমেদ চারটি ভুয়া ঋণপত্রের মাধ্যমে প্রায় ৫৯ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করে দুদক।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছু দুর্নীতি হলেও এখনো তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার ও কঠোর তদারকির কারণে এটা কমে আসছে। তবে কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনের মধ্যে রাখলে এসব আরো কমে আসবে। অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির দীর্ঘসূত্রতাও কমে আসছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী আর্থিক খাতের অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিতে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে দুদক। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দুদক এ ধরনের ২ হাজার ৬৬টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে ২৩১টি মামলাও করে কমিশন।

এছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় অর্থ পাচারের ঘটনাও বাড়ছে। ২০১১ সালে ৭৯টি অভিযোগ অনুসন্ধান করলেও ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১০টিতে। গত বছর ১৮২টি অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক।

সূত্রমতে, ব্যাংক কর্মকর্তারা যেসব অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন, তার বেশির ভাগই আবার নিজেরাই মিটিয়ে ফেলছেন। এছাড়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে অনিয়মে জড়িয়ে পড়লেও বিচার হচ্ছে না। এসব কারণে অনিয়মের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের এমডি মো. নুরুল আমিন বলেন, ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই এমনটি ঘটছে। তবে দু-একটি ঘটনা ঘটলেও এখনো বেসরকারি ব্যাংকিং খাতে সততা টিকে আছে। জবাবদিহিতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির কারণে অনিয়মের ঘটনা কমে আসছে।

ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে, অনিয়মের দায়ে গত তিন বছরে প্রাইম, ইস্টার্ন, যমুনা, শাহজালাল, প্রিমিয়ার, ব্র্যাক, এবি, ইসলামী, দ্য সিটি, স্ট্যান্ডার্ড, পূবালী, ওয়ান, আইএফআইসিসহ বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শতাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত এসব কর্মকর্তাই আবার অনিয়মের দায় নিয়েই যোগদান করছেন অন্য ব্যাংকে। অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত হওয়া প্রাইম ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখার কর্মকর্তারাও সবাই অন্য ব্যাংকে বহাল রয়েছেন।

জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় বেশির ভাগ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার কারণে দুর্নীতির ঘটনা বাড়ছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি রোধে কমিশনের সক্রিয়তা বাড়ানো হয়েছে। জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে তাদের নামে মামলা করা হচ্ছে। অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা গেলে আর্থিক খাতের অনিয়ম কমে আসবে।

দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত

Leave a Reply