ঋণ অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদ অর্জন প্রমাণ মিললেও এমপি এনামুলের ব্যাপারে নীরবতা!
জেসমিন মলি ও সাকিব তনু | ২০১৪-১১-০৬ ইং
রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. এনামুল হকের ২১৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। পাশাপাশি এনামুলের প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশনের বিরুদ্ধে নিয়ম না মেনে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও ছাড় করার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তার পরও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে দুদক। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে জনতা ব্যাংককে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য এনামুলের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনামুল হকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ ছাড়াও তার স্ত্রী তহুরা হকের প্রায় ৪৯ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এনামুল হকের নেট প্রফিট আফটার ট্যাক্স হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। কিন্তু তার বিপরীতে আয়কর দেয়া হয়েছে ৮৭ লাখ টাকা, যা অবাস্তব। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে জমা দেয়া হলফনামা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে শুধু বেতন-ভাতা থেকে তার বছরে আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পর এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা এবং পেশা থেকে বছরে তার আয় ৫০ লাখ টাকা। তার নিজের, স্ত্রীর ও নির্ভরশীলদের মোট ১৬ কোটি সাড়ে ১৮ লাখ টাকার সাধারণ শেয়ার রয়েছে। তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ পাঁচ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। নগদ হিসেবে নিজের ১০ লাখ ও স্ত্রীর হাতে ৫ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। নিজ নামে ব্যাংকে আছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৯১ ও স্ত্রীর নামে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা। দুদকের উপপরিচালক যতন কুমার রায় এ অভিযোগ অনুসন্ধান করেন।
প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দায় ব্যক্তির ওপর বর্তাবে না— এমন পর্যবেক্ষণ থেকে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মামলার সুপারিশ অনুমোদন করেননি দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন। তবে এনামুল হকের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন, তা আমার বিবেচনায় সঠিক মনে হয়নি। এ কারণে আমি অভিযোগটি নথিভুক্ত করার সুপারিশ করেছি।’
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনা প্রপার্টিজের ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্ম মফিজ মিজান অ্যান্ড অগাস্টিন বলেছে, ‘দ্য প্রিপারেশন অব দিস ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টস ইজ দ্য রেসপনসিবিলিটি অব দ্য কোম্পানিজ ম্যানেজমেন্ট।’ অডিট ফার্মের এ বক্তব্য অনুযায়ী কোম্পানির আর্থিক হিসাব-নিকাশের দায় ম্যানেজমেন্টে জড়িত ব্যক্তির ওপরই বর্তায়। এনামুল হক এনা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। এনা প্রপার্টিজ এ গ্রুপেরই প্রতিষ্ঠান।
২১৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনামুল হকের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুদকের তত্কালীন উপপরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা যতন কুমার রায় কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করেন। এনা গ্রুপসংশ্লিষ্ট এনা প্রপার্টিজ, নর্দার্ন পাওয়ার, সালেহা-এমারত স্টোরেজ, এনা ইন্টারন্যাশনাল, এনা এনার্জি লিমিটেড, সালেহা-এমারত ফাউন্ডেশন, এনা বিল্ডিং প্রডাক্ট লিমিটেড, সালেহা-এমারত এগ্রিকালচারাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এনামুল হক।
জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশনের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে নিয়ম ভেঙে ঋণ প্রস্তাব ও অনুমোদনের আগেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে। মূল আমদানি দলিল ব্যাংকের কাছে থাকা সত্ত্বেও আমদানিকারক কর্তৃক বন্দর থেকে মালপত্র ছাড় করা হয়েছে। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও দায় সমন্বয় করা হয়নি, কয়েক দফা চেক ডিজঅনার হওয়ার পরও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ব্যাংকের কাছে কোনো জামানত না থাকা এবং আমদানি করা মালপত্রের ওপর ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার পরও হিসাবটি নিয়মিত রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে এসব অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে জনতা ব্যাংককে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। উপরন্তু দুই দফায় ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়েছে; যা জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ অনুমোদন দিয়েছে। এভাবেই দোষী প্রমাণ হওয়ার পরও অধরাই থাকছেন এনামুল হক ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো।
জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহীর কাটাখালীতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসের মাধ্যমে ঋণপত্র খোলে। ফিনল্যান্ডের ওয়ার্টসিলা ফিনল্যান্ড ওওয়াই থেকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৪২ কোটি টাকা মূল্যের ঋণপত্র খোলা হয়। তবে এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের কোনো ঋণ মঞ্জুর ছিল না। ঋণপত্র স্থাপনের ১৬ দিন পর ২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি ঋণের জন্য আবেদন করে; যা একই বছরের ২৪ নভেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন হয়।
ঋণপত্রের ১৪২ কোটি টাকা ব্যাংকটির লোকাল অফিস ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল পিএডি হিসাবের মাধ্যমে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্টসিলা ফিনল্যান্ডকে পরিশোধ করে। তবে নর্দার্ন পাওয়ার মাত্র ১ কোটি টাকা পরিশোধ করে আমদানিকৃত পণ্য ছাড় করে। পরে নর্দার্ন পাওয়ারের ঋণপত্রের বিপরীতে ১৪২ কোটি টাকা পরিশোধসাপেক্ষে মূল জাহাজি দলিল ছাড়করণের জন্য ব্যাংক শাখা ২০১১ সালে ১৮ বার ও ২০১২ সালে দুবার চিঠি দিলেও দায় পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে গ্রাহক কর্তৃক দুই দফায় ২০ কোটি টাকার চেক প্রদান করা হলেও তহবিলস্বল্পতার কারণে ডিজঅনার হয়। এর পরও আইন অনুযায়ী ব্যাংক শাখা গ্রাহকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংকের লোকাল শাখা নর্দার্ন পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এক চিঠিতে জানায়, ‘সম্প্রতি পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, এরই মধ্যে রাজশাহীর কাটাখালীতে অবস্থিত প্রকল্পস্থলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আপনাদের বিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে; যেক্ষেত্রে মূল জাহাজি দলিল ব্যাংকে সংরক্ষিত, সেক্ষেত্রে ঋণপত্রের মাধ্যমে আমদানিকৃত মালপত্র মংলা বন্দর কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু ব্যাংকের দায় শোধপূর্বক জাহাজি দলিল ছাড় না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্পটি কীভাবে চালু করা হলো, তা বোধগম্য নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংককে জানায়, আন্তর্জাতিক ভ্যাসেলের ক্ষতিপূরণ বা ফি ও মংলা বন্দরের ফি কমানোর জন্য আমরা মালপত্র স্থানীয় লাইটারেজ জাহাজে স্থানান্তর করি। সে সময় মংলা বন্দরের আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। আবহাওয়ার পূর্বাভাস কর্তৃপক্ষ আমাদের মালপত্র স্থানীয় লাইটারেজ জাহাজে নিয়ে নিরাপদে রাখার অনুরোধ করে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অঙ্গীকার করি এবং মালপত্র ছাড় করার অনুরোধ করি। আমরা মালপত্র লাইটারেজ জাহাজে বাঘাবাড়ী বন্দরে নিয়ে যাই। পরে সেখান থেকে কাটাখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়।’
নর্দার্ন পাওয়ার কর্তৃক জাহাজি দলিল ছাড়াই বন্দর থেকে মালপত্র ছাড় করার ঘটনায় জনতা ব্যাংক থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল আমদানি দলিল ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত থাকার পরও বন্দর থেকে অঙ্গীকার করে আমদানি করা মালপত্র ছাড় করার বিষয়টি অস্বাভাবিক। ঘটনাটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় আলোচনা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জনতা ব্যাংকের লোকাল শাখা সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত দুই দফায় বিশেষ বিবেচনায় দেনাটি পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে নর্দার্ন পাওয়ার কর্তৃপক্ষ।
জনতা ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও শাখার ব্যবস্থাপক মনজেরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ঋণটি বর্তমানে নিয়মিত রয়েছে। গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছেন।
দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত
Leave a Reply